বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

মাজার, সংস্কৃতি ও খাবারের টানে—ধর্মীয় পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র সিলেট

সিলেটকে বলা হয় বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী। হযরত শাহজালাল (রহ.) ও হযরত শাহ পরান (রহ.) সহ অসংখ্য আউলিয়ার মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই এখানে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ঢল নামে। কেউ আসেন মানত পূরণের আশায়, কেউবা খুঁজে নেন আধ্যাত্মিক প্রশান্তি। শুধু দেশীয় নয়, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রবাসীরাও পরিবার নিয়ে নিয়মিত আসেন সিলেটের দরগাহগুলোতে। ফলে সিলেট এখন ধর্মীয় ও সংস্কৃতিমূলক পর্যটনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

নগরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শাহজালাল (রহ.)-এর দরগাহে প্রতিদিন গড়ে ১০–১২ হাজার দর্শনার্থীর সমাগম হয়। শাহ পরান (রহ.)-এর দরগাহেও ভিড় করেন হাজারো ভক্ত।

ঢাকা থেকে আগত আনোয়ারা বেগম বলেন, “আমাদের পরিবারের মানত পূরণের জন্য প্রতিবছর সিলেটে আসি। এখানে এসে মনটা শান্ত হয়ে যায়।”

ধর্মীয় ভ্রমণের পাশাপাশি সিলেটের অনন্য সংস্কৃতি ও খাবারও পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ। সাতকরা দিয়ে মাংস, টক মাছ, খাসির কালাভুনা, ভর্তার পদের বৈচিত্র্য পর্যটকদের জন্য এক ভিন্ন স্বাদ তৈরি করে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রফিকুল ইসলাম বলেন, “মাজার ঘুরতে এসে আমরা সিলেটি গান আর খাবারের স্বাদ নিই। এতে ভ্রমণটা আরও আনন্দময় হয়ে ওঠে।”

শুধু খাবারই নয়, স্থানীয় লোকসংগীত, বাউল গান ও আঞ্চলিক সংস্কৃতির আসরও এখন ধর্মীয় পর্যটনের অংশ হয়ে উঠেছে।

অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা পর্যটকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শহরে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট, গাড়ি পার্কিং ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবার অভাবের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় ভ্রমণকারীদের।

বগুড়ার রুবেল মিয়া জানান, “শাহজালাল দরগাহ ঘুরতে এসে গাড়ি পার্কিংয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। ভিড়ের কারণে নিরাপত্তার বিষয়েও দুশ্চিন্তা থাকে।”

ভক্ত ও দর্শনার্থীদের এই সমাগম সিলেটের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। শহরজুড়ে গড়ে উঠেছে শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট ও সুভেনির দোকান। ব্যবসায়ীদের হিসাব অনুযায়ী, মাজারকেন্দ্রিক পর্যটন থেকেই স্থানীয় অর্থনীতিতে বছরে ৪০০–৫০০ কোটি টাকা যোগ হচ্ছে। পাশাপাশি সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।


ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সিলেট (টোয়াস)-এর সভাপতি হুমায়ুন কবির লিটন বলেন, “৫ আগস্টের পর থেকে পর্যটকদের আগমন উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলে হোটেল, রিসোর্ট ও স্থানীয় ব্যবসাগুলোও ক্ষতির মুখে পড়েছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ বাড়ানো জরুরি।”

অন্যদিকে জৈন্তাপুরের উদ্যোক্তা আব্দুর জব্বার জানান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে তাদের এলাকায় পর্যটন ব্যবসা ভালোই চলছে। পরিবার নিয়ে ভ্রমণে আসা মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি হওয়ায় রিসোর্টগুলোতে সারা বছরই ব্যস্ততা থাকে।

সাদাপাথর হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের মালিক আলকাছ আলী বলেন, “পর্যটকরা শুধু মাজার বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই আসেন না, তারা স্থানীয় খাবার, সংস্কৃতি ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ হন। তবে পর্যটনকে এগিয়ে নিতে আধুনিক অবকাঠামো ও আন্তর্জাতিক মানের সেবা বাড়াতে হবে।”

হোটেল গোল্ডেন সিটির জেনারেল ম্যানেজার মৃদুল কান্তি দত্ত মিষ্টু বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকের সংখ্যা কিছুটা কমলেও পূজার ছুটিতে ভালো সাড়া পাচ্ছি। সরকারি সহায়তা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা গেলে সিলেটের পর্যটন আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠবে।”

 

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন, “ধর্মীয় পর্যটন কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের নয়, এটি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রও তৈরি করে। তবে পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা ও স্থানীয় সংস্কৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে এর ইতিবাচক প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসবে। তাই টেকসই ধর্মীয় পর্যটনের জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ জরুরি।”


প্রকৃতির সৌন্দর্যের টান, আধ্যাত্মিক প্রশান্তি, সংস্কৃতির ছোঁয়া ও খাবারের স্বাদ—সব মিলিয়ে সিলেট এখন লাখো পর্যটকের কাছে এক অনন্য গন্তব্য। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অবকাঠামো উন্নয়ন, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রচারণা জোরদার করা গেলে সিলেটকে বৈশ্বিক ধর্মীয় পর্যটনের মানচিত্রে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।

এই সম্পর্কিত আরো