রবিবার, ১৮ মে ২০২৫
রবিবার, ১৮ মে ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

বাংলার বুকে বৃদ্ধাশ্রমবিহীন একটুকরো সিলেট

সুবর্ণা হামিদ

সারা বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা যখন বেড়েই চলেছে তখন ব্যতিক্রম হয়ে দাড়িয়েছে সিলেট। দেশের একমাত্র বিভাগীয় শহর হিসেবে এখানে এখনো নেই কোনো সরকারি বা বেসরকারি নিবন্ধিত বৃদ্ধাশ্রম। এখানকার মানুষ এখনো পরিবারকেই প্রবীণদের শেষ আশ্রয় হিসেবে ধরে রেখেছেন।

প্রায় ৪০ লাখ জনসংখ্যার এই বিভাগীয় শহর ও আশপাশের জেলাগুলোতেও সরকারি-বেসরকারি কোনো নিবন্ধিত বৃদ্ধাশ্রম নেই। সমাজবিদ ও সচেতন মহলের মতে, এটি সিলেটের সামাজিক মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন ও সংস্কৃতির প্রতিফলন।

সিলেট অঞ্চলে প্রবাসী পরিবারের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। তারপরও প্রবীণ পিতা-মাতাকে পরিবারের মধ্যেই রাখা হয়। সন্তান বা নিকট আত্মীয়রা তাঁদের দেখাশোনা করে থাকেন। স্থানীয়দের মতে, পরিবারই প্রবীণদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।

সিলেট এমসি কলেজের এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ মানুষ বৃদ্ধাশ্রমকে 'শেষ আশ্রয়' হিসেবে নয়, বরং 'বিকল্পহীনতা' হিসেবে দেখেন। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মতে, সমাজের ভাঙন যতই হোক, প্রবীণদের দায়িত্ব পরিবারকেই নিতে হবে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিমা বেগম বলেন, আমার দাদা-দাদি আমাদের সঙ্গে থাকেন। আমরা চেষ্টা করি তাঁদের সময় দেওয়ার, গল্প করার। এটা আমাদের দায়িত্ব বলেই মনে করি।

বাদামবাগিচা এলাকার বাসিন্দা, বিশিষ্ট হিতৈষী কবির আহমদ বলেন, “আমার বয়স ৭৫ বছর। এখনো ছেলের সঙ্গে থাকি। ছেলের বউ, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে বাড়িটাই আমার আনন্দের জায়গা। বৃদ্ধাশ্রমের কথা কখনো কল্পনাতেও আসেনি।”

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সিলেট জেলা কমিটির সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “সিলেটে এখনো কোনো বৃদ্ধাশ্রম নেই—এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এটি প্রমাণ করে এখানকার মানুষ পারিবারিক বন্ধন ও প্রবীণদের প্রতি দায়িত্ববোধকে কতটা গুরুত্ব দেয়।”

তিনি আরও বলেন, অনেকে প্রবাসে থেকেও চেষ্টা করেন যেন তাঁদের বাবা-মা পরিবারের সঙ্গেই থাকতে পারেন। এটি আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা আগামী প্রজন্মের জন্যও অনুকরণীয়।

সিলেট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ আব্দুর রফিক জানান, আমাদের তথ্য অনুযায়ী সিলেটে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত কোনো বৃদ্ধাশ্রম নেই। এটি একদিকে সামাজিক শক্তির প্রতিফলন, তবে অন্যদিকে ভবিষ্যতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জও বটে।

তিনি জানান, সুনামগঞ্জে ‘শান্তি নিবাস’ নামে একটি তিনতলা ভবন নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু জনবল না থাকায় সেখানে কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। ভবিষ্যতে সিলেটেও বৃদ্ধাশ্রমের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এজন্য আগাম প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি, যেন পারিবারিক মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন, সিলেটের সামাজিক কাঠামো এখনো যৌথ পরিবারব্যবস্থার প্রতি অনুরক্ত। প্রবাসীদের আর্থিক সহায়তা এবং পরিবারের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা প্রবীণদের পরিবারে রাখার প্রবণতা বজায় রেখেছে।

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে এই চিত্রে পরিবর্তন আসতে পারে। কারণ নতুন প্রজন্ম স্বাধীন ও একক জীবনধারার দিকে ঝুঁকছে, যা যৌথ পরিবারের ধারার সঙ্গে মানানসই নয়। পারিবারিক বন্ধন যতদিন অটুট থাকবে, সিলেট বৃদ্ধাশ্রমবিহীন শহর হিসেবে টিকে থাকবে। তবে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সামাজিক পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকাও জরুরি।

এই সম্পর্কিত আরো