দীর্ঘ ১৫ বছরের রাজনৈতিক অন্তরাল এবং মৃত্যুর পর তিন বছরের আইনী লড়াই শেষে নিজ জন্মভূমি সিলেটের কানাইঘাটে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শায়িত হওয়ার এক বছর পূর্ণ হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল হারিছ চৌধুরীর। ২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর সিলেটের কানাইঘাটে তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদ ও এতিমখানার পাশে তাঁকে পুনর্দাফন করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে পূর্ণতা পায় এই বর্ষীয়ান রাজনীতিকের শেষ ইচ্ছা।
২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হারিছ চৌধুরী। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। ফলে ‘অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান’ ছদ্মনামে সাভারের বিরুলিয়ায় একটি মাদ্রাসার প্রাঙ্গণে তাঁকে দাফন করা হয়। প্রায় তিন বছর পর তাঁর কন্যা ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরীর দীর্ঘ আইনী লড়াই ও উচ্চ আদালতের নির্দেশে মরদেহ উত্তোলন করে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। গত বছর ২৯ ডিসেম্বর সেই দেহাবশেষ সিলেট আনা হলে শেষ হয় এক দীর্ঘ অনিশ্চয়তার অধ্যায়।
২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর দুপুরে যখন হারিছ চৌধুরীর দেহাবশেষ সিলেটের ঐতিহাসিক শাহী ঈদগাহ ময়দানে আনা হয়, তখন সেখানে এক আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কয়েক হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ প্রিয় নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড় করেন। জানাজা ও দোয়া শেষে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কানাইঘাটে। সেখানে ‘শফিকুল হক চৌধুরী মেমোরিয়াল এতিমখানা’র পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় (গার্ড অব অনার) তাঁকে সমাহিত করা হয়। ছাত্র-জনতার ৫ আগস্টের বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এই দাফন প্রক্রিয়া ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সম্মানজনক।
বাবার দাফনের এক বছর পূর্তিতে এবং সম্প্রতি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণের আবহে ৩০ ডিসেম্বর ফেসবুকে একটি মর্মস্পর্শী স্ট্যাটাস দিয়েছেন ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী। তিনি জানান, বাবার ১৫ বছরের পলাতক জীবনে সবসময় একটি ছোট ব্যাগ গোছানো থাকত। বাবার মৃত্যুর পর সেই তালাবন্ধ ব্যাগ খুলে পাওয়া যায় কিছু লুঙ্গি, কয়েক প্যাকেট বাদাম এবং সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা একটি ডায়েরি।
সামিরা লিখেন, ডায়েরির পাতা ওল্টাতেই বেরিয়ে পড়ে দুটি ছবি। একটিতে আমি আব্বুকে জড়িয়ে ধরে আছি, আর অন্যটি তাঁর ম্যাডামের (খালেদা জিয়া)। তাঁর নেত্রী, তাঁর প্রেরণা। আব্বু নেত্রীকে দেওয়া কথা রেখেছিলেন—তাঁকে ছেড়ে বা দেশ ছেড়ে কোথাও যাবেন না। জীবনের বিনিময়ে তিনি সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন।
সামিরা তাঁর স্মৃতিচারণে আরও উল্লেখ করেন, গত বছর যখন তাঁর বাবার পুনর্দাফন সম্পন্ন হচ্ছিল, তখন সারা দেশ তাদের প্রিয় নেতার প্রয়াণে শোকাতুর। টেলিভিশনের পর্দায় বেগম খালেদা জিয়ার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের ক্লিপগুলোতে বারবার হারিছ চৌধুরীর সরব উপস্থিতি ভেসে উঠছিল। নেত্রীর প্রতি হারিছ চৌধুরীর এই অবিচল আনুগত্য ও ত্যাগ রাজনীতির ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে তাঁর অনুসারীরা মনে করেন। আজ ৩০ ডিসেম্বর যখন আব্বুর প্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণ হয়েছে সেখানেও টেলিভিশনগুলোতে আব্বুর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
হারিছ চৌধুরীর এই প্রত্যাবর্তন কেবল একটি মরদেহের স্থানান্তর ছিল না; বরং এটি ছিল ১৫ বছরের নির্বাসন ও মিথ্যার আড়াল ভেঙে সত্যের জয়। আজ দাফনের এক বছর পূর্ণ হওয়ার দিনে সিলেটের মানুষ ও তাঁর রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছেন।