ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় কুপিয়ে ও তীর মেরে হত্যা করা নিহত তিন বাংলাদেশি নাগরিকের লাশ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সীমান্তের কেদারাকোট নামক বাল্লা স্থলবন্দর দিয়ে পতাকা বৈঠকের পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে লাশগুলো বিএসএফ হস্তান্তর করে।
নিহতরা হলেন- চুনারুঘাট উপজেলার আলীনগর গ্রামের আশ্বব আলীর ছেলে জুয়েল মিয়া (৩২), বাসুল্লা গ্রামের কনা মিয়ার ছেলে পন্ডিত মিয়া (৪৫) এবং কবিলাশপুর গ্রামের আব্দুল কদ্দুস মিয়ার ছেলে সজল মিয়া (২০)। গত বুধবার রাতে ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই জেলার বিদ্যাবিল এলাকার আদিবাসীরা তিন বাংলাদেশিকে কুপিয়ে ও তীর মেরে হত্যা করে। পরে ভারতীয় পুলিশ তাদের লাশ উদ্ধার করে সাম্পাহারা থানায় নিয়ে যায়।
বিজিবি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, নিহত তিনজন সম্ভবত গরু পাচারের উদ্দেশে সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন। রাতের অন্ধকারে স্থানীয় জনগণ তাদের ওপর সংঘবদ্ধভাবে হামলা চালালে ঘটনাস্থলেই তারা নিহত হন। পরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা প্রায় ৬ টার দিকে বাল্লা সীমান্ত ফাঁড়ির কমান্ডার আবুল খায়েরের নেতৃত্বে পতাকা বৈঠক শেষে বিএসএফের কাছ থেকে লাশগুলো গ্রহণ করে বিজিবি।
এসময় চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, বানিয়াচং সার্কেল প্রবাস কুমার সিংহ, মাধবপুর সার্কেল একেএম সালিমুল হক, চুনারুঘাট থানার ওসি মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, খোয়াই থানার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কিশোর দেব বর্মা, ওসি কৃষ্ণ ধন সরকার সহ বিজিবি ও বিএসএফ এর উপস্থিতে মরদেহ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করেন। এসময় সজল মিয়ার স্ত্রী মারুফা, নিহত জুয়েল মিয়ার স্ত্রী মাজেদা আক্তার, নিহত পন্ডিত মিয়ার স্ত্রী রুজিনা আক্তার উপস্থিত ছিলেন।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানায়- কয়েক দিন আগে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশের পর এ হত্যাকান্ড ঘটে। হবিগঞ্জ ব্যাটালিয়ন (৫৫ বিজিবি)-এর দায়িত্বাধীন মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার সীমান্তবর্তী বিদ্যাবিল এলাকা দিয়ে তিন বাংলাদেশি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই থানার কারেঙ্গিছড়া এলাকায় প্রবেশ করেন।
নিহতদের পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার নিহত ব্যক্তিরা ভারতে কাজের উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। ধারণা করা হচ্ছে, ভারতে অনুপ্রবেশের পর স্থানীয়রা চোর সন্দেহে তাদের ওপর হামলা চালান। এতে ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান।
বিজিবির বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, ঘটনাস্থলটি সীমান্তের শূন্য রেখা থেকে প্রায় চারপাঁচ কিলোমিটার ভেতরে, যা ভারতের ৭০-বিএসএফ ব্যাটালিয়নের আওতাধীন এলাকা।
হবিগঞ্জ ৫৫ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তানজিলুর রহমান বলেন- প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নিহতরা সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন। স্থানীয়রা চোর সন্দেহে তাদের আটক করে মারধর করে, এতে তারা প্রাণ হারান। বিষয়টি নিয়ে আমরা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করছি। ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বানিয়াচং সার্কেল) প্রবাস কুমার সিংহ বলেন- “ভারতীয় পুলিশ ও বিএসএফের কাছ থেকে আমরা তিন বাংলাদেশির মরদেহ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছি। বর্তমানে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। এই মুহূর্তে বিস্তারিত কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে নিহতদের পরিবার চাইলে আইনগত সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন- ভারতীয় কর্তৃপক্ষ থেকে তিন জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতের পর মরদেহ তাদের পরিবারের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের স্বজনেরা যদি মামলা করতে চান, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভারতের ত্রিপুরায় স্থানীয়দের হাতে তিন বাংলাদেশি নিহত হওয়ার খবরে স্বজনদের আহাজারিতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। নিহতদের বাড়িতে চলছে মাতম- হৃদয়বিদারক দৃশ্য।
তবে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে জানা যায়, বাংলাদেশিদের অবৈধ অনুপ্রবেশ আর অন্যদিকে বাংলাদেশি চোরের তান্ডবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে খোয়াই মহকুমার বিভিন্ন সীমান্ত গ্রামের মানুষ। প্রতিদিন সীমান্তের কোনো না কোনো গ্রামে ঘটছে গরু চুরির ঘটনা। আর তাতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় গৃহস্থরা। সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং গরু চোরের আগমন ইত্যাদি ঘটনাগুলো নিয়ে সীমান্ত গ্রামের মানুষ প্রচন্ড ক্ষুব্ধ স্থানীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উপর। বুধবার সাতসকালে সীমান্ত গ্রাাম বিদ্যাবিলে বাংলাদেশি গরুচোরের আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েছে ২ শ্রমিক। এরমধ্যে মিঠুন তেলেঙ্গা নামে এক যুবককে পাঠানো হয় জিবি হাসপাতালে, অপর যুবক ধীরেন্দ্র তেলেঙ্গাকে বেহালা বাড়ি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়। ঘটনা জানাজানি হবার পর গ্রামের মানুষ তিন বাংলাদেশি গরু চোরকে ধরার জন্য বিদ্যাবিলের একটি জঙ্গল ঘেরাও করে শুরু করে তল্লাশি। পরে গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে নিহত হয় তিন বাংলাদেশি গরু চোর।