আন্নু মালিক লিটন সিলেটের ছাত্রদলের এক তুখোড় নেতা ছিলেন। গোয়াইনঘাট উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের লাখের পাড় গ্রামের আব্দুস শহিদ মিয়ার ছেলে তিনি। স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গোয়াইনঘাট উপজেলায় একের পর এক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি।
একসময় আওয়ামী লীগের আতঙ্ক রূপে আবির্ভূত হন সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাবেক সদস্য আন্নু মালিক লিটন। তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের লক্ষে হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভে উত্তাল ছিল গোয়াইনঘাট। ২০১৪ সালের টানা অবরোধ, টিপাইবাঁধবিরোধী আন্দোলন, এম ইলিয়াস আলীর মুক্তির আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন লিটন।
এসব কারণে একাধিক রাজনৈতিক মামলার আসামি হতে হয়েছিল তাকে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রাধীন বালি-পাথর খোকো চাঁদাবাজ ও চোরাকারবারিদের প্রধান বাধা ছিলেন লিটন আওয়ামী লীগ আমলেও গোয়াইনঘাট ছিল লিটনের নেতৃত্বে বিরোধীদল বিএনপির দুর্গ। তাই সাবেক প্রবাসী ও বৈদেশিক কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ ও তার সমর্থকদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেন তিনি।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সারা দেশে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠন তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলে। গোয়াইনঘাটে সিলেট জেলা ছাত্রদলের অন্যতম নেতা আন্নু মালিক লিটন সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে সরকার পতনের আন্দোলন চালিয়ে যান। তখন সারাদেশে চলছিল বিরোধীদলের উপর গুম, খুন, মাদক দিয়ে ফাঁসানোর মহোৎসব।
গোয়াইনাঘাটের সরকারবিরোধী আন্দোলন থামাতে টার্গেট করা হয় আন্নু মালিক লিটনকে। সিলেট-৪ আসনের সাবেক এমপি ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদের সুপারিশে পুলিশ সুপার হয়ে আসেন জুলাই আন্দোলনের যাত্রবাড়ি গণহত্যা মামলার আসামি এসপি মো. ফরিদ উদ্দিন। গোয়াইনঘাট থানার ওসি তখন হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা ভারতে পাচার এবং সাড়ে ৪ কোটি টাকা ঘুষ আদায়ের মামলার আসামি আবদুল আহাদ।
এসপি ফরিদ সিলেটে আসার পরই গোয়াইনঘাটে গিয়ে একটি আইনশৃঙ্খলা সভায় আন্নু মালিক লিটনকে ইঙ্গিত করে ভালো হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এর কিছুদিন পরই ২০১৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন লিটন। নিখোঁজের পর লিটনের পরিবার, বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা তাকে খুঁজতে থাকেন। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগ করা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটক করা হয়নি বলে জানান। পরবর্তীতে ২৪ সেপ্টেম্বর গোয়াইনঘাট থানার ওসি আহাদের নেতৃত্বে জাফলং চা বাগানে নিয়ে ক্রশফায়ারের প্রস্তুতি নেওয়া হয় বলে জানা যায়। এ খবর জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশ লিটনকে নিয়ে বিপাকে পড়ে। একপর্যায়ে তারা সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমারন আহমদ ও আওয়ামী লীগ নেতা শীর্ষ চোরকারবারী ইমরান আহমদ সুমন ওরফে জামাই সুমনসহ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকে অবহিত করে যে লিটনকে ক্রসফায়ারের বিষয়টি জনগণ এবং গণমাধ্যম কর্মীরা জেনে ফেলেছে, এখন তারা কি করবে বলে পরামর্শ চায় পুলিশ। তখন সাবেক মন্ত্রীইমরানের প্রধান সেনাপতি ও চোরাকারবারিদের গডফাদার জামাই সুমন ছাত্রদল নেতা লিটনকে মাদক দিয়ে ফাঁসানোর ফন্দি আটেন। পরদিন ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে থানা থেকে লিটনের পরিবারকে ফোন দিয়ে জানানো হয় আন্নু মালিক লিটনকে ১ কেজি হিরোইনসহ আটক করা হয়েছে। তবে পরিবারের লোকজন তার সাথে দেখা করতে পারেন নি। পরিবার যখন দেখা করার সুযোগ পায় তখন লিটন গোয়াইনঘাট থানা পুলিশের হেফাজতে অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে ছিলেন। তার দেহে নির্যাতনের চিহ্ন দেখে তার বাবা ও মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। লিটনকে রিমান্ডে এনে করো হয় অমানুষিক নির্যাতন। লিটন যখন ১৪৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে অস্বীকার করেন তখন প্রস্রাবের রাস্তায় কারেন্টের শকসহ বিভিন্ন রকম নির্যাতন করে জবানবন্দি আদায়ের চেষ্টা করা হয়। অবশেষে পুলিশ লিটনকে বলেন যদি তিনি আদালতে ১৪৪ ধারায় জবানবন্দি না দেন তাহালে তার বৃদ্ধ পিতাকে এই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হবে। অবশেষে ছাত্রদল নেতা লিটন নিজের জন্মদাতা পিতাকে বাঁচাতে আদালতে গিয়ে স্বীকারোক্তি দেন। তবে ছাত্রদল নেতা লিটনকে যে ১ কেজি হিরোইনসহ আদালতে প্রেরণ করা হয় সেগুলো ময়দা হিসেবে দাবি করেন তার পরিবার। জব্দকৃত হিরোইন ফরেনসিক টেস্টের জন্য আদালতের মাধ্যমে ল্যাবে পাঠানোর দাবি করলেও পুলিশ তা আমলে নেয়নি। এবং কোনও ধরনের ফরেনসিক ল্যাবের রিপোর্ট ছাড়াই গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে। পুলিশ এই মামলায় কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর স্বাক্ষী হাজির করতে পারেনি। পুলিশের স্বাক্ষ্য ও যোগাযোগি মিথ্যা স্বাক্ষী সৃষ্টি করে লিটনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের চেষ্টা করে পুলিশ। অবশেষে সাড়ে ৩ বছরের মাথায় ২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর আন্নু মালিক লিটনকে ফাঁসির রায় দেন সিলেটের একটি বিচারিক আদালত। এই রায়কে মেনে নেননি তার পরিবার। তাদের দাবি এই রায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ফরমায়েশি বর্তমানে এই মামলা উচ্চ আদালতে ।
অন্নু মালিক লিটনের পরিবার ও তার দল বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠন লিটনের মুক্তির জন্য উচ্চ আদালত ও বর্তমান সরকারের কাছে ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করছেন। তাদের আশা উচ্চ আদালত ন্যায় বিচারের স্বার্থে ফ্যাসিস্ট সরকারের করা ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা থেকে লিটনকে অব্যাহতি দিয়ে তার বৃদ্ধ মা-বাবার কুলে ফিরিয়ে দিবেন।