সিলেটের খাদিমপাড়া এলাকায় আবদুল খালিক বক্স নামের এক ব্যক্তির চাঁদাবাজি, চা-শ্রমিকদের জমি দখল, সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন স্থানীয়রা। নিজেকে বিএনপির নেতা পরিচয় দিয়ে তিনি এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তার উপর নেমে আসে আবদুল খালিক বক্স বাহিনীর হয়রানী ও নির্যাতন। বন্ধ করে দেন মানুষের চলাচলের রাস্তা। এনিয় তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অভিযোগ ও আদালতে মামলা দায়ের করলেও কোনও প্রতিকার মিলছে না ভুক্তভোগীদের।
৭ পরিবার বন্দি: সিলেটের শহরতলির খাদিমপাড়া এলাকায় ৫ লাখ টাকা চাঁদা দিতে না পারায় চার দেয়ালে বন্দি হয়ে আছেন ৭ পরিবারের লোকজন। বাড়ি নির্মাণকালে রাস্তা থাকলেও দেশের পটপরিবর্তনের পর হঠাৎ প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে ৭টি বাড়ির লোকজন। এমনই অভিযোগ ভোক্তভুগী পরিবারগুলোর। এ ঘটনায় বিগত বছরের ৭ নভেম্বর জামাল আহমদ কামাল রাস্তায় দেয়াল নির্মাণ করে চাঁদা দাবিকারী আবদুল খালিক বক্সসহ ৪/৫জনকে অভিযুক্ত করে সিলেটের জেলা প্রশাসক, র্যাব-৯ এর অধিনায়ক, আর্মি ক্যাম্পের কমান্ডার, সিটি করপোরেশনের প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী অফিসার ও উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) বরাবরে অভিযোগ প্রদান করেছেন। তবে অভিযোগ দায়েরের ৮ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পরিবারগুলোর অভিযোগ- আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আবদুল খালিক বক্স জামাল আহমদ কামালের নিকট ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।
চাঁদা না দিলে এই রাস্তা দিয়ে তিনি চলাচল করতে দিবেন না বলে জানান। চাঁদাবাজির এই ঘটনায় ভুক্তভোগী জামাল আহমদ কামাল শাহপরাণ (রহ.) থানা-পুলিশকে জানান। এতে ক্ষুব্ধ হন আবদুল খালিক বক্স। তিনি ৭ পরিবারের দীর্ঘদিনের পুরোনো এজমালি রাস্তার উপর ৮ ফুট উঁচু দেয়াল নির্মাণ করে চলাচলের পথ বন্ধ করে দেন।
আব্দুল খালিক বক্সের ভয়ে অন্য পরিবারগুলো রাস্তা না থাকায় বিচারের আশায় প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কষ্টের টাকায় তিল তিল করে গড়ে তোলা নিজ বাড়িই যেন এখন আবদুল খালিক বক্সের কারণে জেলখানায় পরিণত হয়েছে।
সরেজমিনে সিলেট মহানগরীর খাদিমপাড়া এলাকার ২ নম্বর রোডের বাড়িগুলোর সামনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় সরু একটি রাস্তার মাথায় উঁচু দেয়াল। দেয়ালের ওপারে ৭টি বাড়ি রয়েছে।
বিগত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আবদুল খালিক বক্স সেখানে দেয়াল নির্মাণ করেন। এর ফলে ৭ পরিবার জিম্মি হয়ে আছে।
জানা যায়, সিলেট সদর উপজেলার শাহপরান থানার বহর মৌজার জে এল নং ৭০, খতিয়ান নং- ৫০৪/১৫৯৮, ডিপি ১৭৮৪, বর্তমানে সে. জ. জে এল নং ৬১, দাগ নং- ৭৫, নালিশা রাস্তা রকম ভূমি ৭.৫০ শতক রাস্তাসহ বাড়ী। তাছাড়া আরো ৬টি বাড়ি রয়েছে সেখানে। পুলিশি তদন্ত ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রাস্তাটি জামাল আহমদ ও শরীকানদের মালিকানাধীন ব্যাক্তিগত রাস্তা।
শাহপরান (রহ.) থানা প্রদত্ত প্রতিবেদনে দেখা যায় নালিশা ভূমি দীর্ঘদিন থেকে চলাচলের রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন রাস্তার তলদেশ দিয়ে স্থাপন করা হয়েছে।
উক্ত ভূমির এস এ রেকর্ডিয় মালিকরা জমি বিক্রয়ের সময় দলিলে উক্ত রাস্তাটিকে সরেয়াম রাস্তা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এরকম কিছু দলিলে আবদুল খালিক বক্স স্বাক্ষী হিসেবেও স্বাক্ষর করেছেন। এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, রাস্তাঘাট প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকার।
পরিবারগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই বাড়িতেই বসবাস করে আসছে। ৫ আগস্টের পর হঠাৎ রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে অন্যায় কাজ করেছেন আবদুল খালিক বক্স। আমরা চাই তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
নালিশা ভূমির পূর্ববর্তী মালিক, হীরা মিয়া জানান আমি রাস্তাসহ ভূমি বিক্রি করেছি দীর্ঘদিন থেকে সেখানে রাস্তা ছিলো তবে হঠাৎ শুনতে পেয়েছি আবদুল খালিক বক্স রাস্তাটি বন্ধ করে দিয়েছেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যে কেউ কারও প্রতি অন্যায় জুলুম করার কোনো সুযোগ নেই।
উল্লেখ্য, উপরোক্ত রাস্তা দিয়ে চলাচলে বাধা প্রদানের প্রেক্ষিতে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এর আদেশে শাহপরান (রহ.) থানায় রাজু আহমদ নামক অপর ব্যক্তি বাদি হয়ে আবদুল খালিক বক্সদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন তার তদন্ত প্রতিবেদনে নালিশা ভূমির রাস্তাটি দীর্ঘদিন ধরে সরেয়াম রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ৭টি পরিবার এই রাস্তা দিয়েই চলাচল করে যাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন।
চা- শ্রমিকদের জমি দখলচেষ্টা:
সিলেট শহরতলির খাদিমপাড়ায় ১০ থেকে ১২টি চা-শ্রমিক পরিবারের জমি দখলের অপচেষ্টায় অভিযোগ উঠেছে একটি ভূমিখেকো চক্রের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় ০২ জুন সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে খামিদপাড়া ২ নম্বর রোডের বাসিন্দা শেফু বক্সের ছেলে আবদুল খালিক বক্সকে প্রধান আসামি করে ৭ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৪২ জনের নামে মামলা দায়ের করেছেন চা-শ্রমিক প্রদীপ ব্যানার্জী (৪১)।
প্রদীপ ব্যানার্জী সিলেট মহানগরীর শাহপরাণ থানাধীন চামেলীবাগ রোড নং-২ এর গোয়ালগাঁওয়ের বাসিন্দা।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন শাহপরাণ এলাকার মোহাম্মদপুরের রশিদ মিয়ার ছেলে খোকন আহমদ একই এলকার শহিদ মিয়া (৫০), জাহানপুরের হাতিম আলীর ছেলে মাসুক পীর (৪৫), খামিপাড়া রোড নং-২ এর মৃত ঈদ্রিসের ছেলে সিরাজ মিয়া (৬০) একই এলকার হান্দু মিয়ার ছেলে জয়নাল মিয়া (৪০), শাহপরাণ এলাকার মোহাম্মদপুরের রশিদের ছেলে রোকন মিয়া (৪৫)।
মামলা সূত্রে জানা যায়, সিলেট মহানগরীর খাদিমপাড়া এলাকায় ‘দিনকছিল ডেটিভ টি এন্ড লেন্ডস কোম্পানী লিমিটেড’র নালিশা ভূমিতে চা-শ্রমিক প্রদীপ ব্যানার্জীর (৪১) পূর্ব পুরুষরা ৬০ বছর ধরে কাজ করছেন। সেই সুবাদে টি কোম্পানী চা- শ্রমিকদের পরিবার পরিজন নিয়ে বসাবস করার জন্য ১০-১২টি পরিবার শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস ও ভোগ দখল করে আসছেন। চা-শ্রমিকরা দীর্ঘকাল থেকে সেখানে ১ একর জমিতে শ্মশানঘাট নির্মাণ করে তাদের আত্মীয় স্বজনদের সৎকার করে আসছে। তাছাড়া চা শ্রমিকরা নালিশা ভূমিতে বসতঘর বিদ্যুৎ সংযোগ, হোলিন্ডং ট্যাক্স প্রদান করে তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে আসছেন। চা শ্রমিকদের পূর্ব পুরুষ রাজ কুমার গোয়ালা ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি নালিশা ভূমির ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে ডিসিআর প্রাপ্ত হন। সম্প্রতি ভূমিখেকো চক্র সন্ত্রাসী আবদুল খালিক বক্সদের কুনজর পড়ে চা শ্রমিকদের বসবাসকৃত বাড়িঘর ও পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া জমির উপর। পাশাপাশি চা-শ্রমিকদের উচ্ছেদ করতে আবদুল খালিক বক্স ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী পাঁয়তারা চালিয়ে আসছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় ২৭ মে সকাল ১০টায় ভূমিখেকো সন্ত্রাসী আবদুল খালিক বক্স ও তার বাহিনী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চা-শ্রমিকদের বসত ভিটায় প্রবেশ করে উচ্ছেদ করতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে বাড়িঘর ভাঙচুর, হামলা ও লুটপাট চালায়। এসময় চা-শ্রমিকরাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললে এলাকার লোকজনের ধাওয়ায় সন্ত্রাসী আবদুল খালিক বক্স ও তার বাহিনী পালিয়ে যায়। যাওয়ার পূর্বে চা-শ্রমিক প্রদীপ ব্যানার্জীসহ অন্যদের হত্যার হুমকি দিয়ে বলে যায় তারা আবারও দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে জমি দখল করতে আসবে।
এমন পরিস্থিতিতে চা-শ্রমিক প্রদীপ ব্যানার্জী ও তাদের সম্প্রদায়ের প্রতিবেশীরা বর্তমানে ভূমিখেকো সন্ত্রাসী আবদুল খালিক বক্স ও তার বাহিনীর সাথে যেকোনও সময় সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন। এমতাবস্থায় চা-শ্রমিকরা তাদের মালিকানাধীন দখলীয় ভূমি রক্ষার্থে প্রশাসনের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।