বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে একটি দলের প্রত্যাশিত জুলাই সনদ উপস্থাপন করা হলে জাতি সেই সনদ প্রত্যাখ্যান করবে।
ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর জাতি এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। মানুষের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে জামায়াতে ইসলামী ৫ আগস্ট পরবর্তী রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার ও গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ অংশগ্রহনমূলক, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানিয়েছে।
এই দাবির প্রতি দেশের জনগণ সমর্থন দেখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনসহ ১১টি কমিশন গঠন করে।
সকল সংস্কার কমিশনকে জামায়াতে ইসলামী সহযোগিতা করলেও একটি দল নিজেদেরকে রাষ্ট্রের মালিক মনে করে সরকারকে যথাযথ সহযোগিতা করেনি, করছে না। তারা সংস্কার চায় নিজেরদের মতো করে। দুই সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার আত্মদান এবং ৫০ হাজারের অধিক আহত জুলাই যোদ্ধাদের গণ-অভ্যুত্থানের আইনি স্বীকৃতির মাধ্যমে জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবরূপ দিয়ে ফ্যাসিবাদের পথ চিরতরে বন্ধ করতে জামায়াতে ইসলামীসহ দেশপ্রেমিক সচেতন সকল নাগরিক দাবি জানিয়েছে। জাতির প্রত্যাশিত ঘোষণাপত্র উপস্থাপিত না হলে, জনগণ সরকারের ঘোষিত ঘোষণাপত্র মেনে নিবে না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাজধানীর পল্টন মোড়ে ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামীর আয়োজিত গণমিছিল পূর্বক অনুষ্ঠিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় তিনি বলেন, একটি দল ক্ষমতায় গিয়ে সব সংস্কার মুছে দেওয়ার ঘোষণায় জনমনে সংশয় তৈরি হয়েছে। তারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ভূমিকায় আবির্ভূত হতে চায়। বাংলাদেশের জনগণ আর কোন ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা হতে দিবে না। ফ্যাসিবাদের পতনের মাধ্যমে ৫ আগস্ট বাংলাদেশের আকাশে বিজয়ের আভাস নিয়ে নতুন সূর্য উদিত হয়েছিল।
নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃশ্যই জুলাই যোদ্ধাদের প্রশান্তি এনে দিবে উল্লেখ করে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, যিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন সেই মহান নেতা ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে। বৈষম্যহীন, ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের এক কল্যাণ ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জামায়াতে ইসলামী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। নতুন বাংলাদেশে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, দুর্নীতির কোন স্থান হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা আবারো রাজপথে নেমে আসবে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জনগণ রাজপথে নামলে আওয়ামী লীগের চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।
জুন কিংবা ফেব্রুয়ারি যখনই নির্বাচন হোক, এর আগে সংস্কার ও গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে উল্লেখ করে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান বলেছিলেন, জুনের পর তিনি একদিনও ক্ষমতায় থাকবেন না। পরবর্তীতে তিনি সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। তার পরবর্তীতে তিনি একটি দলের সাথে বিদেশের মাটিতে আলাদা বৈঠক করে আবার ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছেন। নির্বাচন যখনই হোক আগে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়ে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে যেভাবে হ্যাঁ/না (গণভোট) ভোট দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে বৈধতা দিয়েছেন।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও একইভাবে নিজের ক্ষমতাকে বৈধতা দিয়েছেন। সেভাবে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই ঘোষণাপত্রের বৈধতায় কারোই আপত্তি থাকার কথা নয়। ইভিএম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইভিএম একটি মেশিনের নাম, পিআর একটি পদ্ধতিগত দিক। যিনি বলেন, মানুষ ইভিএম বুঝে না আসলে তিনি না বুঝলেও বাংলাদেশের ঠেলাওয়ালা, ভ্যান চালক, রিকশা চালক, চা-পান বিক্রেতাও পিআর পদ্ধতি বুঝে। তিনিও পিআর পদ্ধতি ঠিকই বুঝেন কিন্তু বুঝাতে চান না। জাতির জন্য রাজনীতি করলে পিআর মেনে নিতে তিনি সব দলের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির মো. নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে এবং কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ইসলামি ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, জুলাই এক চেতনার নাম। এই জুলাই মানুষকে শোষন থেকে মুক্তি দিতে, বৈষম্যহীন একটি ইনসাফভিত্তিক ন্যায় বিচার ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের নাম।
জুলাইয়ের চেতনা সারা বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। নতুন বাংলাদেশে আর কোন ফ্যাসিবাদ কায়েমের চেষ্টা সফল হতে দেওয়া হবে। যারা নতুন করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ভূমিকায় নিজেদের অধিষ্ঠিত করতে চায় ইসলামি ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে এদেশের ছাত্র-জনতা তাদের প্রতিহত করবে। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতি পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়তে আহবান জানান।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন- কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা -১০ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর আব্দুস সবুর ফকির, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমির, ঢাকা-৮ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী অ্যাডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি, ঠাকুরগাঁও -১ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী দেলাওয়ার হোসেন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি, ঢাকা -৫ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী মোহাম্মদ কামাল হোসেন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি, ঢাকা-৬ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী ড. আব্দুল মান্নান, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মদ শামছুর রহমান, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, ঢাকা -৯ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী কবির আহমেদ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য, ঢাকা -৪ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন প্রমুখ।
এছাড়াও সমাবেশে মহানগরীর কর্মপরিষদ সদস্য যথাক্রমে- অধ্যাপক মোকাররম হোসাইন খান, অ্যাডভোকেট এসএম কামাল উদ্দিন, অধ্যাপক নুর নবী মানিক, আব্দুস সালাম, ডা. আতিয়ার রহমান, ড. মোবারক হোসেন, কামরুল আহসান হাসানসহ শূরা ও কর্মপরিষদ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সভাপতির বক্তব্যে নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ছাত্র-জনতার চেতনা ছিল বৈষম্যহীন আধিপত্যবাদ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের চেতনা। কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী একটি দল পুরোনো নিয়মেই দেশ গড়ার মনোভাব পোষণের মাধ্যমে জাতির সঙ্গে নতুন করে প্রতারণার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা জুলাই চেতনার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে জুলাই আন্দোলনের শহীদ ও আহতদের সাথে বেঈমানীর পথে হাঁটছে। তিনি আরও বলেন জুলাই ঘোষণাপত্রের আইনি ভিত্তি দিয়ে বাস্তবরূপ দিতে হবে। নতুবা জুলাই ঘোষণাপত্র নামক এক টুকরো কাগজ জনগণ গ্রহন করবে না, মেনে নিবে না।
নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, বিচার ও সংস্কার ছাড়া কোন নির্বাচন নয়, পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মতামতের সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা যেনতেন নির্বাচন দিয়ে কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করলে জনগণ সেটি প্রতিহত করবে।
তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা আবারো ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় মদদ দিচ্ছি অভিযোগ করে বলেন, নিরপেক্ষতা হারালে পরিণতি আওয়ামী লীগের চেয়েও ভয়াবহ হবে। তাই তিনি সরকারের ভিতরে ও বাহিরে থেকে কোনো ষড়যন্ত্র না করে জুলাই চেতনা বাস্তবায়নে সকলকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
সমাবেশ শেষে, এক বিশাল গণমিছিল পল্টন মোড় থেকে প্রেসক্লাব - মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগে গিয়ে শেষ হয়। মিছিলে জামায়াতে ইসলামীর সর্বস্তরের নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করে।