অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক শুরু হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকে অংশ নিতে শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টার দিকে লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে পৌঁছান তারেক রহমান। সেখানে তারেক রহমানকে স্বাগত জানান প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। এরপরই দুই নেতার বৈঠক শুরু হয়।
নির্বাচন-সংস্কারসহ চলমান রাজনৈতিক নানা ইস্যুতে বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যকার উত্তেজনা যখন চরমে, তখন প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির শীর্ষ নেতার এমন একটি বৈঠক আশাবাদী করে তুলছে রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে দেশবাসীকে।
আলোচনার বিষয়বস্তু ও ফলাফল জানার জন্য দেশে ও বিদেশে থাকা বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা-আগ্রহের যেন কমতি নেই।
আলোচনার এজেন্ডা অফিশিয়ালি কোনো পক্ষ প্রকাশ করেনি। তবে স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন, বিচার, সংস্কারসহ রাজনীতিতে সাম্প্রতিক যুক্ত হওয়া অনেক বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিদেনপক্ষে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নিয়ে আসা অন্যতম এজেন্ডা হিসাবে তুলে ধরা হবে। এটি একরকম নিশ্চিত। বিপরীতে সরকার চাইবে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময়সীমা ধরে রেখে সংস্কার ও বিচারের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে।
যদিও নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে হবে।তবে প্রয়োজনে সর্বোচ্চ আগামী বছরের জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারিতে হলেও আপত্তি নেই দলটির।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বারবার বলছেন, নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে হবে।
নির্বাচনের এই দিনক্ষণ নিয়ে বিএনপির পাশাপাশি দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলও একই দাবি জানিয়ে আসছে। এই দাবির পক্ষে যুক্তিও তুলে ধরছে বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো। তবে অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, সংস্কার শেষে ছাব্বিশের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি তারিখে নির্বাচনের আয়োজন করবে।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে বহুল কাঙ্ক্ষিত একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এপ্রিলের প্রথমার্ধ আর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের মধ্যে সময়ের ব্যবধান মাত্র ২ মাস। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যদি ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক সমর্থন-সহযোগিতা নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজও এ সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করে ফেলা সম্ভব হবে। তখন সংস্কারের জন্য অতিরিক্ত ২ মাস সময় নিয়ে উত্তপ্ত বৈরী আবহাওয়া আর রমজানজুড়ে নির্বাচনি কর্মকাণ্ডের মধ্যে দেশকে নিয়ে যেতে হবে না। এক্ষেত্রে শুধু দরকার দুপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আস্থার সম্পর্ক, যা সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈঠক প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাদের মধ্যকার অনুষ্ঠিত বৈঠকে অনেক বিষয়ে সমাধান হতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি। বর্তমানে যে একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সেটারও সমাধান আসতে পারে।
এই নির্বাচনের দিনক্ষণ ইস্যুতে উত্তাপ পরিস্থিতির মধ্যে আজ (১৩ জুন) লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমান বৈঠকে বসেছেন। টানা ২ ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সবমিলিয়ে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল ও দেশবাসী লন্ডনের এই বৈঠকের দিকেই তাকিয়ে আছে।
বৈঠক শেষে বিএনপির পক্ষ থেকে লন্ডনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ব্রিফিং করতে পারেন বলে জানা গেছে। তিনি বর্তমানে লন্ডনের এই বৈঠকে উপস্থিত রয়েছেন।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলটির দিক থেকে কী কী বিষয়ে আলোচনা হবে- সে সম্পর্কে তারেক রহমানকে দলের স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কিছু মতামত দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, নির্বাচনের সময়। প্রধান উপদেষ্টা ঈদুল আজহার আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের যে ঘোষণা দিয়েছেন, লন্ডন বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে সে ‘সময়সীমা’ পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানানো হবে। এক্ষেত্রে বিএনপি ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের দাবি থেকে কিছুটা সরে আসবে, যাতে সরকার আরেকটু এগিয়ে আসে। বিএনপি মনে করে, এপ্রিল মাস ভোটের জন্য উপযোগী সময় নয়। কারণ, এই সময়ে প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া থাকে, ঝড়বৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। তার আগে রোজা ও ঈদুল ফিতর। এমন সময়ে ভোট করতে গেলে রমজান মাসেও নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে হবে। তাই বিএনপি আশা করে, সরকার ভোটের সময় এগিয়ে আনার বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। তবে সরকার এপ্রিলে অনড় থাকলে বিএনপির পক্ষে মানা কঠিন হবে।
এখন দেখার বিষয়, বিএনপির নির্বাচনের দিনক্ষণের যে প্রত্যাশা- সেটি বৈঠক থেকে পূরণ হয় কিনা। বৈঠক শেষে দুপক্ষের আনুষ্ঠানিক প্রেস ব্রিফিংয়ের পর বোঝা যাবে, নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে কোনো ঐকমত্য হলো কিনা।