জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া অভ্যুত্থানের সময় পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ায় তাঁকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছরের সাজার লঘুদণ্ড। তবে এ রায়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি শহীদ ও আহত পরিবারের সদস্যরা।
রায়ের দিনকে কেন্দ্র করে আজ সোমবার (১৭ নভেম্বর) সকাল থেকে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। ট্রাইব্যুনালের সামনে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালে প্রবেশের সব গেটেই বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। পথচারী থেকে আইনজীবী—সবার পরিচয় যাচাই করে প্রবেশের অনুমতি মিলেছে। ট্রাইব্যুনালের ফটকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে ছিলেন। সেনাবাহিনী ও ডিএমপির সাঁজোয়া যান ছিল সেখানে।
রায় ঘোষণা শেষে বিকেলে ট্রাইব্যুনালের প্রধান ফটকের সামনে জুলাই আন্দোলনে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, ‘আজকে যে রায় হয়েছে, সেই রায়ের মাধ্যমে শহীদ ও আহত পরিবার সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়নি। আমাদের তিন নম্বর আসামির (সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন) বেলায় যে রায়টি দেওয়া হয়েছে, সেই রায়ে শহীদ ও আহত পরিবার সন্তুষ্ট নয়। যদিও সে রাজসাক্ষী, তার সেই প্রিভিলেজ দেখিয়ে তাকে এই রায় দেওয়া হয়েছে।’
স্নিগ্ধ আরও বলেন, ‘রাজসাক্ষী হলেও তাকে অন্ততপক্ষে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া উচিত ছিল। তার মৃত্যুদণ্ড হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু রাজসাক্ষী হওয়ার জন্য তাকে যে প্রিভিলেজ দেওয়া, সেটি সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি কোর্ট বিবেচনায় নেয়নি। এর জন্য শহীদ ও আহত পরিবার সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট নয় এবং আমরা অবশ্যই উচ্চ আদালতে ও আরও কোনো জায়গায় যদি আপিল করার সুযোগ থাকে, সে জায়গায় শহীদ ও আহত পরিবারদের পক্ষ থেকে আপিল করব।’
তবে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদী। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। কোনো স্বৈরাচার সারা জীবন মানুষকে নিষ্পেষণ করে বেঁচে থাকতে পারবে না। এ রায়ই এর প্রমাণ।
আর এ রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) সাদিক কায়েম। তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে দ্রুত নিয়ে আসতে হবে। ইন্টারপোলসহ আন্তর্জাতিক সব মাধ্যম ব্যবহার করে শেখ হাসিনা ও তাঁর দোসরদের দেশে নিয়ে এসে দ্রুত রায় কার্যকর করতে হবে।
সাদিক কায়েম আরও বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম, খুনি হাসিনার নির্দেশে চানখাঁরপুল থেকে শুরু করে সাভারসহ সারা দেশে যে গণহত্যা চালানো হয়েছিল, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছিল—সেই পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা ডাকসুর পক্ষ থেকে সরকার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে তার অপরাধ অনুযায়ী ন্যায্যবিচারের দাবি করছি।’
এদিকে রায় ঘোষণার পরপর ট্রাইব্যুনালের প্রধান ফটকের সামনে উল্লাস প্রকাশ করেন জুলাই যোদ্ধারা। এ সময় তাঁরা নানা স্লোগান দিতে থাকেন।
আর কেউ কেউ মিষ্টি বিতরণ ও শোকরানা নামাজ আদায় করেছেন। নামাজ আদায় করা মোহাম্মদ মাসুদ ঢালী বলেন, ‘আজকের রায়ে আমি খুশি। শেখ হাসিনার ১ হাজার ৪০০ বার ফাঁসি হওয়া উচিত। রায় শুনেই আমি দুই রাকাত শোকরানা নামাজ পড়েছি। আরও পড়ব।’
এই মঞ্চের ব্যানারে রায়পরবর্তী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসিনুর রহমান বলেন, ‘আমাদের উচ্ছ্বাস বোঝাতে পারব না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া ন্যায়বিচার পেয়েছি। এই বিচার কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আমার প্রশান্তি আসবে না, তারপরও আমি হাসতেছি।’
একইভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর বেলা ৩টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে উপস্থিত মানুষ মিষ্টি বিতরণসহ আনন্দমিছিল করেন। মিছিলটি শুরু হয় টিএসসির মেট্রোরেল স্টেশন থেকে। পরে মিছিলটি ভিসি চত্বর থেকে ব্যবসায় অনুষদ হয়ে ডাকসু ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হয়।