আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালা থেকে অনেকে মুক্ত হলেও এখনো খোঁজ মেলেনি গুমের শিকার বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর। সিলেট-২ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্যের খোঁজ নেই এক যুগের বেশি সময় ধরে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম কমিশনে ইলিয়াস আলীর সন্ধান না পাওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে তার পরিবার।
ইলিয়াস আলীকে না-পাওয়া কিংবা তার গুমের বিচার নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছেন তার স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা। গুমের মামলা করতে পারছেন না দেশে এ-সংক্রান্ত আইন নেই বলে। আবার তার মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাননি বলে হত্যা মামলাও করতে পারছেন না।
এমনটাই জানিয়েছেন তাহসিনা রুশদীর লুনা। তবে স্বামীকে একদিন ফিরে পাবেন- আশা করেন তিনি।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে গাড়িতে করে বনানীর বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন তখনকার বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ইলিয়াস আলী। তার সঙ্গে নিখাঁজ হন গাড়িচালক আনসার আলীও। রাত ১২টার পর মহাখালী থেকে পরিত্যক্ত পাওয়া যায় তার গাড়িটি। ওই দিনই ছাত্রদলের দুই নেতা জুনেদ ও দিদার নিখোঁজ হন। তাদেরও সন্ধান মেলেনি আজও।
বিএনপির রাজনীতিতে সাংগঠনিকভাবে বেশ শক্ত অবস্থান ছিল ইলিয়াস আলীর। সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন প্রবলভাবে সরব। রাজধানী এবং সিলেট- দুই জায়গাতেই আন্দোলন চাঙা করতে ভূমিকা রাখেন তিনি। তার নিখোঁজের পর থেকে তাই রাজনৈতিক ও সাধারণ্যে সন্দেহ, বিএনপির এই নেতাকে গুম করেছে সরকারি লোকজন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর র্যাবের সাবেক একজন এসআই মাসুদ রানা ফেসবুক লাইভে বলেন, ‘ইলিয়াস আলী বেঁচে নেই। অনেক আগেই তাকে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।’
মাসুদ রানার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন তাহসিনা রুশদীর লুনা। তিনি বলেন, ‘কেউ একজন ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কিছু একটা বলল, সেটা বিশ্বাস করব না। শুনলাম লুকায়িত থেকে একজন এসআই লাইভে এসে ইলিয়াস আলীকে খুন করা হয়েছে এমনটি বলেছে। সে যদি আমাকে এসে কথাটা বলত, তাহলে তথ্য পাওয়ার একটা সুযোগ হতো।’
আওয়ামী লীগ আমলে যারা আয়নাঘরে কিংবা বন্দিদশায় ছিলেন তাদের অনেকে মুক্ত হয়েছেন। আবার এখনো নিখোঁজ অনেকে। তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে গুম কমিশন। বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, ‘আমরা গুম কমিশনে অভিযোগ দিয়েছি। এরপর সেখান থেকে জানানো হয় তারা আয়নাঘরগুলো পরিদর্শন করেছেন, সেগুলো ক্লোজ করেছেন। তবে ইলিয়াস আলীর বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’
সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজে খবর প্রকাশিত হয়, ইলিয়াস আলীর গুমের সঙ্গে র্যাবের কর্মকর্তারা জড়িত। তবে এই খবর ভিত্তিহীন বলে দাবি করে বাহিনীটি। ২০২২ সালের ২১ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে এলিট ফোর্সটির তৎকালীন মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দাবি করেন, ইলিয়াস আলীকে যখন থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তার স্ত্রী তাদের কাছে গিয়েছিলেন, তাকে তারা সর্বোচ্চ আইনি সহায়তা দিয়েছেন। তিনি যখন যে সন্দেহ করেছেন, যখনই কোনো তথ্য দিয়েছেন, র্যাব অভিযান পরিচালনা করেছে।
র্যাবের দাবি প্রসঙ্গে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে ইলিয়াস আলীর স্ত্রী বলেন, ‘র্যাব কী সহায়তা করেছে? তারা সহায়তা করার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। কীভাবে কী সহায়তা করবে তারা? র্যাব, পুলিশ, ডিজিএফআই, তৎকালীন সরকার, শেখ হাসিনা— সবাই এই গুমের সঙ্গে জড়িত।’
গুমের শিকার ইলিয়াস আলী উদ্ধারে তার পরিবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে ওই বছরের ২ মে। তিন সন্তান নিয়ে গণভবন থেকে বেরিয়ে তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করেছেন, তার স্বামীকে উদ্ধারে সব ধরনের চেষ্টা করবেন। সেদিন আর কিছু বলতে চাননি লুনা। সেদিন গণভবনে এমন কী ঘটেছিল যা প্রকাশ্যে বলতে চাননি তিনি?
তাহসিনা রুশদীর লুনার কাছে জানতে চায়, শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তিনি তখন গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাননি, এখন তো বলতে পারেন। এমন প্রশ্নে ইলিয়াস পত্নী বলেন, ‘আমি তখন যা বলেছি , এর বেশি এখনো বিস্তারিত কিছু বলছি না।’
তবে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) মিজানুর রহমান মিজান বলেন, ‘শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়। তার নির্দেশেই চূড়ান্ত কিছু ঘটেছে, এমন তথ্যও শোনা যায়। ২০১২ সালে ঢাকায় যুবদলের একটা কর্মসূচিতে কয়েক লাখ লোক আনার পরিকল্পনা ছিল। ওই অনুষ্ঠানের কো-অর্ডিনেট করছিলেন ইলিয়াস আলী। এটাই তার অপরাধ। শেখ হাসিনা মনে করেছিলেন সরকারকে উৎখাত করতে ইলিয়াস আলী পরিকল্পনা করছেন। তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য গুম করা হয়।’
ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় এখন মামলা করবেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, ‘দেশে গুমের তো কোনো আইন নেই মামলার। আগে আইন আনতে হবে। আমি তো এখন হত্যা মামলা করতে পারব না, তাহলে তো ডেথ সার্টিফিকেট (মৃত্যুসনদ) দেখাতে হবে। আমি তো বলতে পারব না উনাকে মার্ডার করা হয়েছে।’
ইলিয়াস আলীর সঙ্গে গুম হন তার গাড়িচালক আনসার আলী ও ছাত্রদলের দুজন নেতা। তাদের কোনো সন্ধান মিলেছে কি না জানতে চাইলে তাহসিনা রুশদীর লুনা বলেন, ‘না। তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।’
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী যখন গুম হন তখন তার তিন ছেলেমেয়ে ছোট। বর্তমানে তার বড় ছেলে আবরার ইলিয়াস ব্যারিস্টার। তিনি আইন পেশায় জড়িত। ছোট ছেলে লাবিব শারা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (সিএ) পড়ছেন। আর একমাত্র ছোট মেয়ে সাইয়ানা নাওয়াল একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
১৯৬১ সালে সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার রামধানায় জন্মগ্রহণ করেন ইলিয়াস আলী। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এরশাদের সামরিক আইনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় ইলিয়াস আলীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় তখন।