আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’ মোকাবিলার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি আশঙ্কা করেছেন, ‘নির্বাচন বানচালের জন্য ভেতর ও বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে। ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে বানচালের চেষ্টা করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ চলে আসতে পারে।’ যত ঝড়ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন, সেটা অতিক্রম করতে হবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে।
গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তার সভাপতিত্বে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস এমন আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এর আগে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যমুনায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করে সভার আলোচ্য বিষয়গুলো জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম। প্রধান উপদেষ্টার বরাত দিয়ে প্রেস সচিব আরও জানান, আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। নির্বাচন সংক্রান্ত সব প্রস্তুতি ১৫ নভেম্বরের মধ্যে শেষ করতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এদিকে নিজ জেলা-শ্বশুরবাড়ি এলাকায় ডিসি-এসপি-ইউএনওদের পোস্টিং হবে না উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেছেন, পদায়নের ক্ষেত্রে নিজ জেলায় কেউ যাবেন না। বিশেষ করে, আত্মীয় কিংবা শ্বশুরবাড়ি যদি থাকে, সেখানে পোস্টিং হবে না। আরেকটি বিষয় দেখা হবে, পদায়নের ক্ষেত্রে নিকট আত্মীয় কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে কি না। এ বিষয়ে যে কাজ, সেটি ১ নভেম্বর থেকে শুরু হবে।
বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এহছানুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিনিয়র সচিব আখতার হোসেন, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক একেএম শহিদুর রহমান, কোস্টগার্ড মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. জিয়াউল হক, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীসহ অনেকে। এ ছাড়া তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, স্থানীয় সরকার বিভাগ, তথ্য ও সম্প্রচার এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবও উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন—সোশ্যাল মিডিয়ার অপপ্রচার আসবে। নির্বাচন বানচাল করার জন্য দেশের ভেতর থেকে, বাইরে থেকে খুবই পরিকল্পিতভাবে নানা রকম অপপ্রচার চালানো হবে। এআই ছবি-ভিডিও তৈরি করে ছেড়ে দেওয়া হবে। এটাকে সামাল দিতেই হবে। একটা অপপ্রচারের রচনা হওয়া মাত্র সেটা ঠেকাতে হবে, যেন ছড়াতে না পারে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আগামী নির্বাচন সুন্দর ও উৎসবমুখর করতে হলে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। নির্বাচনী নীতিমালা, ভোটকেন্দ্রের নিয়ম, কীভাবে ভোট প্রদান করতে হবে, কোথাও বিশৃঙ্খলা হলে কী করতে হবে— এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে আরও বেশিসংখ্যক টিভিসি, ডকুমেন্টারি বা ভিডিও তৈরি করা এবং তা যেন খুব দ্রুত ইউটিউবে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসে, সেই নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সবাই যেন এটা দেখে নিজেরাই অনেক ক্ষেত্রে প্রস্তুত হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান প্রেস সচিব।
১ নভেম্বর থেকে মাঠ প্রশাসন গোছানো শুরু: নির্বাচনকালীন মাঠ প্রশাসন প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। প্রথমে মাঠ প্রশাসনের পদায়ন নিয়ে আলোচনা হয়। ১ নভেম্বর থেকে মাঠ প্রশাসন গোছানোর কাজ শুরু হবে।
তিনি বলেন, মাঠ প্রশাসনে যেন এমন পদায়ন না হয়, যারা গত তিনটি নির্বাচনে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেখানে তারা রিটার্নিং অফিসার, পোলিং অফিসার বা অ্যাসিস্টেন্ট রিটার্নিং অফিসার হিসেবে থাকুন না কেন, গত তিন নির্বাচনে তাদের যদি ন্যূনতম ভূমিকা থাকে তাহলে যেন পদায়ন না হয়, এ বিষয়ে বলা হয়েছে।
প্রেস সচিব বলেন, ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এরই মধ্যে পদায়নের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পদায়নের ক্ষেত্রে কী কী ক্রাইটেরিয়া হবে, এসব বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। যিনি সবচেয়ে বেশি ফিট তার ক্রাইটেরিয়ায় আগের পোস্টিং, রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড, কর্মদক্ষতা, তার বিরুদ্ধে কোনো নিউজ আছে কি না অনেক বিষয় দেখা হচ্ছে। কতটুকু ফিট এবং যিনি ফিট তাকে দেওয়া হবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায়। এগুলো র্যান্ডমলি (দ্বৈবচয়ন পদ্ধতি) নির্বাচন করা হবে।
শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমাদের সেরাটা আশা করতে হবে, কিন্তু সবচেয়ে খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতির জন্য যেন প্রস্তুত থাকি আমরা। পদায়নের ক্ষেত্রে নিজ জেলায় কেউ যাবেন না। বিশেষ করে আত্মীয় কিংবা শ্বশুরবাড়ি যদি থাকে, সেখানে পোস্টিং হবে না। আরেকটি বিষয় দেখা হবে, পদায়নের ক্ষেত্রে নিকট আত্মীয় কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে কি না। আর এ বিষয়ে যে কাজ, সেটি ১ নভেম্বর থেকে শুরু হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রেস সচিব আরও বলেন, তারাও এভাবে দেখছেন, কে সবচেয়ে বেশি ফিট। তারা এরই মধ্যে একটা তালিকাও করে ফেলেছেন ৬৪ জনের। এ ক্ষেত্রে যাতে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ থাকে, সেটিও লক্ষ্য রাখতে প্রধান উপদেষ্টা বারবার বলছেন।
প্রতি উপজেলায় এক কোম্পানি সেনা: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন নিয়ে আলাপ হয়েছে। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বলা হয়েছে, ৯২ হাজার ৫০০ জন সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। তার মধ্যে ৯০ হাজার সেনাসদস্য, বাকিটা নৌবাহিনী। সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রত্যেক উপজেলায় এক কোম্পানি করে মোতায়েন থাকবে। এ ছাড়া নির্বাচনের ৭২ ঘণ্টা আগে এবং নির্বাচনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি স্থানীয় জনগণ, স্বেচ্ছাসেবক সম্পৃক্ত করে কীভাবে সামলানো যায়; সে বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে।
ভুয়া তথ্য ও অপতথ্য মোকাবিলায় দুই কমিটি: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য ও ভুয়া তথ্যের বিষয়ে প্রেস সচিব বলেন, নির্বাচনে ভুয়া তথ্য ও অপতথ্য মোকাবিলায় দুটি কমিটি গঠনের বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। দুটি কমিটিই উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কাজ করবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্য বা ভুয়া তথ্যের ফ্যাক্ট যাচাই করে তা প্রকাশ করবে। এর জন্য কারিগরি সহায়তা দেওয়ার জন্য আইসিটি মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা হবে।