অস্ত্র মামলায় আট দিনের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে। পুলিশের পাশাপাশি টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেলের (টিএফআই) সদস্যরা ঢাকার অপরাধ জগতের এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর উত্থানের শুরু থেকে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত অপরাধের ফিরিস্তি জানার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া পুলিশের খাতায় মোস্ট ওয়ান্টেড হওয়া, ভারতে পালিয়ে যাওয়া, সে দেশে গ্রেপ্তার, নেপালের কারাগারে সুড়ঙ্গ করে পালিয়ে যাওয়া, বাংলাদেশে পুশব্যাক এবং আয়নাঘর থেকে মুক্ত হওয়াসহ নানা বিষয়ে জেরা করা হচ্ছে সুব্রত বাইনকে। কোনো কিলিং মিশন পরিচালনার জন্য কেউ তাকে ‘সুপারি’ (চুক্তিভিত্তিক লেনদেন) বা টাকা দিয়েছিল কিনা, এ বিষয়েও দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাকে।
জিজ্ঞাসাবাদে সুব্রত বাইন জানিয়েছে, নেপালের কারাগার থেকে পালাতে নিজ সেলের ভেতর থেকে ৭৭ ফুট দীর্ঘ সুড়ঙ্গ করে সে। আর এ লক্ষ্যে সে ওই কারাগারে বন্দি ২০ জনের একটি টিম গঠন করে। এ কাজে তাদের সার্বিক সহায়তা করে কারাগারেরই এক নিরাপত্তা রক্ষী। প্রথমে তাকে নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে গোলাগুলি করে পালাতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সার্বিক দিক বিবেচনায় সুব্রত বাইন এতে রাজি হয়নি। তখন অনুপ্রবেশের মামলায় সাজা খেটে কারাগার থেকে বেরুতে আর তিন মাস বাকি ছিল।
২০০৩ সালে ভারতে পালানোর পর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স ২০০৮ সালের ১৩ অক্টোবর তাকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার গা-ঢাকা দেয় সুব্রত বাইন। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায় কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্স। এ সময় ধাওয়া খেয়ে সুব্রত বাইন নেপাল সীমান্তের কাকরভিটা শহরে ঢুকে পড়ে, তার পিছু নেন কলকাতা পুলিশের দুই কর্মকর্তা। এ সময় নেপালের ভেতর দুই পুুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে সুব্রতর ব্যাপক ধস্তাধস্তি হয়। তখন সেখানে হাজির হয় নেপালি পুলিশ। সুব্রত বাইন নেপালি পুলিশকে জানায়, তাকে অপহরণ করতেই এ দুজন ভারত থেকে এসেছে। তখন নেপালি পুলিশ ভারতের দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ তাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর সুব্রতকে প্রথমে পূর্ব নেপালের ভদ্রপুর কারাগারে নেওয়া হয়। সেখান থেকে নেপালের ঝুমকা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। গ্রেপ্তারের এক সপ্তাহ পর ভারতীয় দূতাবাসের হস্তক্ষেপে ছাড়া পান পুলিশের দুই কর্মকর্তা। ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর ঝুমকা কারাগার থেকে ৭৭ ফুট সুড়ঙ্গ কেটে পালিয়ে যায় সুব্রতসহ ১২ জন। ২৭ নভেম্বর কলকাতার বউবাজারের একটি বাসা থেকে সুব্রতকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় পুলিশ। ফতেহ আলী নাম নিয়ে ছদ্মবেশে সে সেখানে অবস্থান করছিল।
সুব্রত বাইন জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, ভুল করে একটি ফোনকল করার ফলেই কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্সের প্রধান রাজিব কুমার নেপাল সীমান্তে তার অবস্থান শনাক্ত করেন। এরপর তাকে ধরতে পুুলিশের বিশেষ টিম পাঠানো হয়। আর তাকে ধরতে কলকাতা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করছিলেন কলকাতায় আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশি এক সন্ত্রাসী। সে এখনও কলকাতাতেই আছে।
কী কারণে কুষ্টিয়ায় আশ্রয় নিলেনÑ এ ব্যাপারে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের জেরার মুখে একেক সময় একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। কখনও বলছে, অস্ত্র কিনতেই কুষ্টিয়ায় গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে ৮০ হাজার টাকা করে দুটি ভারতীয় অস্ত্র ক্রয় করে। আবার বলছে, নিরাপদ জায়গার খোঁজেই ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় চলে যায়। কয়েক সপ্তাহ আগে ভারত থেকে কুষ্টিয়ায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ। সুব্রত বাইনের হাত ধরে অপরাধ জগতে সে নিজের নাম লেখায়।
ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৬ আগস্ট ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত বন্দিশালা থেকে ছাড়া পেয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন মগবাজার, রামপুরা, গুলশান, বাড্ডাসহ আশপাশ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জোর চেষ্টা চালায়। এ নিয়ে দুবাইয়ে গা-ঢাকা দেওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ক্ষুব্ধ হয় সুব্রত বাইনের ওপর; তাকে হত্যার ছকও কষে। একদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায়। এরপর জিসান বাহিনীকে টেক্কা দিতে সুব্রত বাইন একের পর এক অস্ত্র কেনা শুরু করে। এ বিষয়েও সুব্রত বাইনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ চারজনকে গত মঙ্গলবার ঢাকা ও কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। অভিযানে তাদের কাছ থেকে পাঁচটি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি ও একটি স্যাটেলাইট ফোন জব্দ করার কথা জানায় আইএসপিআর। গ্রেপ্তারের পর গত বুধবার তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করা হয়। এরপর সুব্রত বাইনকে অস্ত্র আইনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আট দিনের রিমান্ডে নেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার এসআই রিয়াদ আহমেদ। গত শুক্রবার তার কাছে জানতে চাওয়া হয়Ñ পুলিশ রিমান্ডে কী ধরনের তথ্য দিচ্ছে সুব্রত বাইন? জবাবে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশে ন্যস্ত করা হয়েছে। তাই এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলতে পারছেন না তদন্তের স্বার্থে।
পুলিশ রিমান্ডে সুব্রত বাইনকে রাখা হয়েছে মিন্টো রোড গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে। সেখানেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন টিএফআই সেলের সদস্যরা। শুক্রবার রাতে তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গতকালও পালাক্রমে জেরা করেন পুলিশের তদন্তকারীরা। দেশে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির জন্য তার কোনো পরিকল্পনা ছিল কিনা, এ ব্যাপারে গতকাল সুব্রতকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ ছাড়া আয়নাঘর থেকে মুক্ত হওয়ার পর কার কার সঙ্গে দেখা করেছে; তাদের পেশাগত ও রাজনৈতিক পরিচয় কীÑ এসব বিষয়েও মুখ খুলেছে সুব্রত বাইন।