রাজধানীর হাতিরঝিল থানার একটি অস্ত্র আইনের মামলায় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
একই সঙ্গে আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদসহ ৩ জনের ৬ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
আজ বুধবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন শুনানি শেষে এই রিমান্ডের আদেশ দেন।
রিমান্ডের অপর দুই আসামি হলেন- সুব্রত বাইনের দুই সহযোগী আরাফাত ইবনে নাসির ওরফে শ্যুটার আরাফাত ও এম এ এস শরীফ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাতিরঝিল থানার এসআই রিয়াদ আহমেদ আসামিদের ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন।
এদিকে রিমান্ড শুনানির আগে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ২০২২ সাল থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত আড়াই বছর আয়না ঘরে থাকার দাবি করেছেন সুব্রত বাইন।
আজ তাকে রিমান্ড শুনানির জন্য আদালতে হাজির করা হলে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি এ দাবি করেন।
সুব্রত বলেন, ‘আমাকে আড়াই বছর আয়নাঘরে রাখা হয়। আমি নাকি চুরি করি, ছিনতাই করি। এখন কত কী বানায়। আমার কোনো পাওয়ার দরকার নেই। আমি চাইলে নিজেই টিভি খুলতাম। সাংবাদিক রাখতাম। ২০২২ সালে রমজান মাসের ২৬ তারিখ ভারত থেকে আমাকে বাংলাদেশে ঢোকানো হয়।’
তিনি বলেন, ‘এরপর আমাকে আড়াই বছর ধরে আয়নাঘরে রাখা হয়। গত ৫ আগস্ট রাত ৩টার দিকে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমার মাথায় রড দিয়ে পিটিয়ে শেষ করে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বাঁচার জন্য অস্ত্র রাখি। আমি যদি বলি অস্ত্র রাখি না, তাহলে এটা মিথ্যা হবে। লিয়াকত, মুরগি মিলন এরা আমার শত্রু ছিল। এদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমি এই জায়গায় এসেছি।’
তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘সাংবাদিকরা যেন তদন্ত করে সত্যিটা লেখেন। আমি যা সেটাই যেন লেখেন। সত্যি কথা লিখবেন। হলুদ সাংবাদিক হবেন না। ৮৯ সাল থেকে আমার বিরুদ্ধে লিখছেন। আপনারা কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিছু লিখবেন না। সাংবাদিকদের বোঝা উচিত, তারা কী লিখছেন, তার প্রভাবে কী হতে পারে। আমার পরিবার আছে। ৬১ বছর বয়স হয়ে গেছে।’
সুব্রত বাইন বলেন, ‘এই আধুনিক যুগে যদি আমাকে চাঁদাবাজ বানান? এই আধুনিক যুগে যদি চাঁদাবাজ না ধরতে পারেন, তাহলে কী লাভ সাংবাদিকতা করে। তদন্ত করেন, কে আমার নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করলো। আপনারা নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক। দোয়া করি আপনাদের জন্য।’
তিনি বলেন, ‘আমার কোনো পাওয়ার নাই, পাওয়ার দরকারও নাই। পাওয়ার আমার পিছে ঘোরে। সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়ারকে আমি সেজদাহ করি।’
এরপর বিচারক এজলাসে উঠলে তিনি আইনজীবীকে খোঁজেন। বলেন, ‘মজিবর ভাই কই। আমার উকিল কই।’
তিনি বিচারকের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাতকড়া পড়ে দাঁড়ানো যায়। যতটুকু আইন জানি, আদালতে দাঁড়ানোর সময় হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে রাখে না। তাহলে আদালতের সম্মান কি রইলো।’
রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি তে বলেন, ‘আসামিরা খুবই আলোচিত। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে আরও কারা জড়িত রয়েছে, আরও অস্ত্র উদ্ধারের লক্ষে দশ দিনের রিমান্ড প্রয়োজন।’
আসামিদের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ বাদল মিয়া রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করে বলেন, ‘সুব্রত বাইন আজকে মিডিয়ার সৃষ্টি। তাকে মিডিয়ায় সৃষ্টি করেছে। তৎকালীন সরকার তাদের শত্রুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই লিস্টে করেছে। এরপর আর কোন সরকার কোনো লিস্ট তৈরী করেননি। এই আসামিকে ভারতে তিনবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে ৬ তারিখে নরসিংদীর ভুলতা এলাকায় ফেলে রেখে চলো যায়। ওই সময় তিনি অনেক ভয় পেয়েছেন। সুব্রত বাইন টোটালি ইনোসেন্ট। প্রয়োজনে তাদের কেন্দ্রীয় কারাগারে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘আসামির কিডনি এবং লিভারের সমস্যা রয়েছে। আসামিদের কাছ থেকে অনেক কিছু জব্দ করা হলেও একটা মোবাইল জব্দ দেখানো হয়নি।’
এরপর আদালত সুব্রত বাইনের ৮ দিন এবং অপর ৩ আসামির ৬ দিন করে রিমান্ডের আদেশ দেন। রিমান্ড আদেশের পরে আদালতকে সুব্রত বাইন বলেন, ‘আমার নামাজ যেন কাজা না হয়। নামাজের ব্যবস্থা যেন থাকে। আদালত পুলিশকে বিষয়টি দেখতে বলেন।’
এর আগে গত ২৭ মে ভোর ৫টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ অভিযানে কুষ্টিয়া জেলা থেকে সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও মোল্লা মাসুদ ওরফে আবু রাসেল মাসুদকে গ্রেপ্তার হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইনের দুই সহযোগী শ্যুটার আরাফাত ও শরীফকে। বুধবারই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করা হয়।
নব্বইয়ের দশকে ঢাকার অপরাধজগতের আলোচিত নাম ছিল সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী। ঢাকায় আধিপত্য বিস্তার করে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিতে তার নাম আসা ছিল তখনকার নিয়মিত ঘটনা। এসব কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য খুন-জখমের জড়িয়েছেন। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেছেন। জামিনে বেরিয়ে আবারও যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন অপরাধে।
সুব্রত বাইনের পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। জন্ম ১৯৬৭ সালে, ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার জোবারপাড় গ্রামের সন্তান সুব্রত বাইন। মা ও তিন বোনকে নিয়ে মগবাজারে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। সুব্রত ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। ছেলেবেলায় পড়াশোনা শুরু বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন স্কুলে, পরে ঢাকায় শেরেবাংলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন সুব্রত। সেখান থেকেই এসএসসি পাস। কলেজে ওঠার পর সুব্রতর অপরাধজগতে প্রবেশ। সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে এক নেতার সঙ্গে পরিচয় হয় তার। সেই সূত্র ধরে অস্ত্র হাতে নেওয়া। পরে মগবাজারে গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী।
১৯৯৩ সালে রাজধানীর মধুবাজারের এক সবজিবিক্রেতা খুনের ঘটনায় পুলিশের নজরে আসেন সুব্রত বাইন। এরপর মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণের সময় চাঁদাবাজির ঘটনায় তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর দ্রুতই হয়ে ওঠেন ভয়ংকর অপরাধী। মগবাজার, রমনা, কারওয়ান বাজার, মধুবাগ- এসব এলাকা ছিল সুব্রত বাইনের দখলে। ১৯৯১ সালে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদ খুনের ঘটনায় সুব্রত বাইনের যাবজ্জীবন সাজা হয়।