বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ হওয়া সত্ত্বেও গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা ইস্যুতে যুক্তরাজ্য নিশ্চল। ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা, উলটো ব্রিটিশ সরকারের অনেক পদক্ষেপই ইসরাইলের পক্ষে যাচ্ছে। এমনকি সরাসরি ইসরাইলের গণহত্যায় নানাভাবে সহায়তারও অভিযোগ রয়েছে দেশটির বিরুদ্ধে।
এসবে ক্ষিপ্ত হয়ে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ব্রাইজ নর্টন সামরিক ঘাঁটিতে ঢুকে পড়েন ফিলিস্তিনপন্থি অ্যাকটিভিস্ট সংগঠন ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’-এর কয়েকজন সদস্য। তারা ঘাঁটিতে থাকা দুটি বিমানে লাল রঙ ছিটিয়ে দেন। আর এটাকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আখ্যা দিয়ে ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ব্রিটিশ সরকার।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এই ইস্যুতে গত বুধবার হাউস অব কমন্সে ভোটাভুটি হলে এর পক্ষে ভোট ভোট দেন ৩৮৫ জন এমপি, আর বিপক্ষে ভোট দেন ২৬ জন। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়া এমপিদের মধ্যে দুজন ব্রিটিশ–বাংলাদেশি। তারা হলেন, বাংলাদেশের পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক এবং রুশনারা আলী। তারা দু’জনই যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি।
অন্যদিকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্বতন্ত্র এমপি আপসানা বেগম প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। প্রথম হিজাব পরা মুসলিম নারী এমপি হিসেবে আলোচিত আপসানা শুরু থেকেই ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’ নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘লাল রঙ ছিটানো, প্রতীকী প্রতিবাদ ও শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধকে সন্ত্রাস আখ্যা দেওয়া ভয়ংকর ও অগণতান্ত্রিক’।
ভোটে অংশ নেননি বা ভোট রেকর্ড হয়নি আরেক লেবার এমপি রুপা হকের।
ব্রিটিশ সরকার দাবি করেছে, আইনি প্রতিবাদের ছদ্মাবরণে প্যালেস্টাইন অ্যাকশন সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ধ্বংসে লিপ্ত হয়েছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে সন্ত্রাসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার এক বিপজ্জনক নজির সৃষ্টি হলো।
যুক্তরাজ্যের স্বতন্ত্র আইনপ্রণেতা জারা সুলতানা এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘একটি স্প্রে ক্যান আর আত্মঘাতী বোমার মধ্যে তুলনা টানা শুধু হাস্যকর নয়, এটি নৈতিকভাবে বিকৃত। এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনে, (নৈতিক) সংহতিকে অপরাধ হিসাবে দেখাতে এবং সত্যকে ধামাচাপা দিতে আইনের অপব্যবহার।’
প্যালেস্টাইন অ্যাকশনকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা। এক বিবৃতিতে ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’ নামের সরাসরি কর্মসূচিভিত্তিক প্রতিবাদী গোষ্ঠীকে ২০০০ সালের সন্ত্রাসবাদ আইনে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ না করতে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ আন্দোলনকে ভিত্তিহীনভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেওয়ার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সম্পত্তির ক্ষতি ঘটানো—যদি তা মানুষ হত্যা বা আঘাতের উদ্দেশ্যে না হয়—তবে তাকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে গণ্য করা যায় না।’
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যুক্তরাজ্যের প্রধান নির্বাহী সাশা দেশমুখ এই নিষেধাজ্ঞাকে ‘অতিরিক্ত আইনি ক্ষমতার নজিরবিহীন উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত সরকারের হাতে এমন ক্ষমতা দিচ্ছে, যার মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন, নজরদারি বৃদ্ধি এবং মানুষকে আটক করা সহজ হবে।