সিলেট মহানগরী ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন স্থানে হেপাটাইটিস 'এ' ও 'ই' ভাইরাসজনিত জন্ডিসের প্রাদুর্ভাব আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে।
জন্ডিসের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, শহরের প্রধান হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে প্রতিদিনই জন্ডিসে আক্রান্ত নতুন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। সিলেট বিভাগজুড়ে গত এক মাসে জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
এ ব্যাপারে সিলেট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন, হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ ভাইরাস দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমেই ছড়ায়, এবং এগুলোর সংক্রমণ থেকেই জন্ডিস দেখা দেয়। তবে আতঙ্কিত না হয়ে, যদি আমরা সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকি এবং বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করি, তাহলে এ রোগ সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে এবং পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। তিনি আরও বলেন, পরীক্ষায় যদি হেপাটাইটিসের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পাওয়া যায়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। এছাড়া, যদি আগে থেকেই হেপাটাইটিসের টিকা নেওয়া থাকে, তবে অনেকাংশেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
তবে, এক বছরের আগে রুটিন ইপিআই-তে যদি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা দেওয়া হয়, তবে লিভারের মারাত্মক রোগ থেকে অনেকাংশেই রক্ষা পাওয়া যায়।
সাধারণত এই ভাইরাস দুটি দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। অপরিষ্কার পরিবেশ, সঠিকভাবে রান্না না করা খাবার, এবং অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণেই এই ভাইরাস সহজে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে শরীরে লিভারের কার্যক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এ ব্যাপারে সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে এই রোগটি সাধারণত পানি বা বাইরের দূষিত খাবার থেকে ছড়ায়, এবং এতে ভয় বা আতঙ্কের কিছু নেই।
খাবারে অরুচি, চোখ ও ত্বকের রঙ হলুদ হয়ে যাওয়া, খাবার খাওয়ার পর বমি হওয়া—এই উপসর্গগুলো দেখা দিলে কিছু পরীক্ষা করাতে হবে। যদি দেখা যায় রোগের মাত্রা বেশি, তাহলে আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে থাকি।
তিনি আরও বলেন, এই রোগের সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা হলো বিশ্রাম। সেই সঙ্গে কিছু সহজ সতর্কতা মেনে চললেই রোগী দ্রুত সেরে উঠতে পারে। যেমন: বিশুদ্ধ পানি পান করা, বাইরের খাবার পরিহার করা, এবং যথেষ্ট বিশ্রামে থাকা।
ডা. জিয়াউর রহমান চৌধুরী সাধারণ জনগণকে উদ্বেগ না করে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় ঘরে বিশ্রাম এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার মাধ্যমে জন্ডিস থেকে সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
এ ব্যাপারে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ গোলাম রব মাহমুদ শোয়েব বলেন, দূষিত পানি এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ, যা বর্তমানে জন্ডিসের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এই ভাইরাসগুলো সাধারণত গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বেশি সক্রিয় থাকে, কারণ এ সময় পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বিশুদ্ধ পানি পান করা, রাস্তার খোলা খাবার এড়িয়ে চলা, এবং সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
সিলেট সিটি করপোরেশনের অন্তত ৮টি ওয়ার্ডে নিরাপদ পানির অভাব দেখা দিয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। নগরীর আম্বরখানা, বড় বাজার, গোয়াইটুলা, খাসদবীর, টিলাগড়, পাঠানটুলা, কাজিরবাজার, বন্দরবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। অনেক জায়গায় ট্যাপের পানি থেকে দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এ ব্যাপারে শাহজালাল উপশহরের বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, পানির গন্ধে অনেক সময় বমি চলে আসে। এক মাসে আমাদের বাসায় তিনজন জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছেন।
গোয়াইটুলা এলাকার বাসিন্দা ডলি বেগম বলেন, আমার ১০ বছরের ছেলে সহ আমাদের পুরো পরিবার জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছিল। আমাদের এলাকায় পানির সংকট অত্যন্ত গুরুতর, যার ফলে অধিকাংশ লোকই এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। যদি সিটি করপোরেশন এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তবে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে।