বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে কিশোর-কিশোরীরা। গবেষণা বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী কিশোর-তরুণ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকবে। এই বয়সীদের মধ্যে এইচআইভি বা এইডস, অকাল গর্ভধারণ, অনিরাপদ যৌনতা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, অপুষ্টি ও দুর্ঘটনার মতো সংকট বেড়ে যাবে। যার অনেকগুলোই প্রতিরোধযোগ্য বা চিকিৎসাযোগ্য হলেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হবে না বলে আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা।
মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে প্রকাশিত ‘ল্যানসেট কমিশন অন অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িং’-এর দ্বিতীয় প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষকেরা বলেছেন, বিশ্বে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজের অগ্রগতি খুবই ধীর এবং অসম। ফলে অনেকে তরুণ বয়সে এসে পেছনে পড়ে যাচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য এখন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন এক গবেষক জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সারা বের্ড।
২০১৬ সালে ল্যানসেট এই বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন করেছিল। নতুন এই প্রতিবেদনটিতে গত ১০ বছরে কিশোর স্বাস্থ্যের পরিবর্তন পর্যালোচনা করা হয়েছে। কিছু ইতিবাচক দিক উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কিশোরদের মধ্যে ধূমপান ও অ্যালকোহল সেবনের হার কমেছে। বেড়েছে শিক্ষার হার। অনেকেই মাধ্যমিক শেষ করে কলেজে যাচ্ছে। তবে এসব সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে নতুন ও বাড়তে থাকা সমস্যার কারণে।
বেড়েছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও স্থূলতা
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আরও তীব্র ও ব্যাপক হয়েছে। অন্যদিকে আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু অঞ্চলে কিশোরদের স্থূলতার হার ৮ গুণ বেড়েছে। এর চেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এক দশকেও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি রয়েছে কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের। গত ৩০ বছরে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য অনেকটাই খারাপের দিকে গেছে। কোভিড-১৯ মহামারিতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা ও আত্মহত্যার কারণে কিশোর প্রজন্ম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ৪ কোটি ২০ লাখ ‘সুস্থ জীবন বছর’, যা ২০১৫ সালের তুলনায় ২০ লাখ বেশি।
এছাড়াও বিশ্বজুড়ে অস্বাভাবিক হারে স্থূলতা বাড়ছে বলে জানিয়েছে ল্যানসেট কমিশন। ২০৩০ সালের মধ্যে উন্নত দেশ, ল্যাটিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রতি তিনজন কিশোরের একজন অতিরিক্ত ওজনের হতে পারে। বিশ্বজুড়ে অতিরিক্ত ওজনের কিশোরের সংখ্যা ২০১৫ সালে ছিল ৩২ কোটি ১০ লাখ। ২০৩০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৪৬ কোটি ৪০ লাখে।
আরেকটি বড় সমস্যা অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যাচ্ছে। ল্যানসেটের প্রতিবেদন বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি তিনজন কিশোরীর একজন এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। রক্তশূন্যতা ক্লান্তি, শারীরিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া এবং গুরুতর ক্ষেত্রে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতির সঙ্গে জড়িত। অথচ এই সমস্যার সমাধানে অগ্রগতি খুব ধীর।
আগামীতে কিশোর স্বাস্থ্য ও কল্যাণে বৈশ্বিক অগ্রগতি নির্ধারণে জনসংখ্যাগত পরিবর্তন মুখ্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যালেক্স ইজে। তিনি বলেন, ‘আফ্রিকার কিশোর-কিশোরীদের বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব বর্তমানে ২৫ শতাংশের নিচে। ২১০০ সালের মধ্যে তা বেড়ে ৪৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ফলে আফ্রিকায় কিশোরদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে অগ্রগতি না হলে বৈশ্বিক পর্যায়ে এই বয়সভিত্তিক উন্নয়ন থমকে যাবে।’
জলবায়ু পরিবর্তন ও ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব
ল্যানসেট কমিশন বলছে, আগামী কয়েক দশকে কিশোরদের স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে দুটি উদীয়মান বিষয়—জলবায়ু পরিবর্তন ও ডিজিটাল প্রযুক্তি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আজকের তরুণেরা ইতিমধ্যেই অনুভব করছে। এই প্রজন্মই প্রথম, যারা গড়ে শিল্পবিপ্লব-পূর্ব সময়ের তুলনায় অন্তত শূন্য দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রায় বেড়ে উঠছে।
২১০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বাড়তে পারে ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি পর্যন্ত। এই বাড়তি তাপমাত্রা কিশোরদের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করবে—তাপজনিত অসুস্থতা, খাদ্য ও পানির সংকট, এবং জলবায়ু-জনিত মানসিক সমস্যার মতো নানা সংকট দেখা দেবে।
কমিশনের এক নতুন পর্যালোচনায় উঠে এসেছে, আকস্মিক দুর্যোগ (যেমন ঝড় বা ঘূর্ণিঝড়) ও দীর্ঘমেয়াদি সংকট (যেমন-খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা) কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পিটিএসডি (ট্রমাজনিত মানসিক চাপ), উদ্বেগ ও বিষণ্নতার মতো সমস্যাও বাড়ছে।
পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমও এ প্রজন্মের তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
ল্যানসেট কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল জীবন কিশোরদের জন্য এক ধরনের দ্বিমুখী তলোয়ার। একদিকে এটি তরুণদের শেখা, কাজ করা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার নতুন সুযোগ এনে দিচ্ছে। অন্যদিকে, অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা এখন ভার্চুয়াল মাধ্যম দখল করে নিচ্ছে। যদিও গবেষণা এখনো সীমিত, তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মানসিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
কমিশনের মতে, এখানে ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। অপ্রয়োজনীয়ভাবে কিশোরদের বিচ্ছিন্ন না করে আগাম প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
২০১৬ সালে প্রকাশিত ল্যানসেটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রায় ১০০ কোটি কিশোর-তরুণ এমন দেশে বাস করে যেগুলো ‘বহুমুখী-সংকটপূর্ণ দেশ’। সেসব দেশে তরুণ প্রজন্ম প্রতিদিন নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ছে। এখন সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১০ কোটিতে। জরুরি পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ২০৩০ সালেও এই সংখ্যাটা ১০০ কোটির ওপরেই থাকবে বলে প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়।
এই সব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কিশোরদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে অর্থায়ন যথেষ্ট নয়। বিশ্বের জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ হলো কিশোর-কিশোরী। তারা বৈশ্বিক রোগ-ভার বোঝার ৯ শতাংশের সম্মুখীন। তবু তাদের জন্য বরাদ্দ বৈশ্বিক সহায়তা মাত্র ২.৪ শতাংশ।
তরুণদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে বিনিয়োগ ছাড়া ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখা সম্ভব নয় বলে মনে করেন অধ্যাপক সারা বের্ড। তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই কিশোরদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে স্কুলগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো এবং কিশোরদের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।’
কমিশনের ভাষ্য, এটি অত্যন্ত দুর্বল বিনিয়োগ কৌশল। তরুণদের ওপর ব্যয় করলে তার ফলাফল শিশুদের প্রাথমিক বয়সে বিনিয়োগের সমান বা কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি হতে পারে। তবে বাস্তবে দেখা যায়, অর্থ বরাদ্দ হয় মূলত প্রাপ্তবয়স্ক বা ছোট শিশুদের জন্য। এর পেছনে অন্যতম কারণ, কিশোরদের স্বাস্থ্য নিয়ে বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে শক্ত নেতৃত্ব ও সমন্বয়ের ঘাটতি।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. অ্যারন জেনকিন্স বলেন, ‘মানব কল্যাণের প্রাকৃতিক ভিত্তিকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের দ্বিতীয় ল্যানসেট কমিশন যেভাবে কিশোর স্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিয়ে কাজ করেছে, তা আমাকে গভীরভাবে আশাবাদী করেছে। প্রথমবারের মতো আমরা এমন হস্তক্ষেপ চিহ্নিত করছি যা একযোগে কিশোর স্বাস্থ্য, পরিবেশ রক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ এবং সামাজিক ন্যায়ের অগ্রগতি ঘটাতে পারে।’
এই গবেষণায়র বিশেষত্ব হলো, তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। ২৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ১০ জন ‘ইয়ুথ কমিশনার’ বিভিন্ন খাত যেমন শিক্ষা, সিভিল সোসাইটি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিত্ব করে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বই কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এ ছাড়া, ৩৬টি দেশের ২০০-রও বেশি কিশোর অংশ নিয়েছে ‘ইয়ুথ সলিউশন ল্যাব’-এ। তারা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অগ্রাধিকার ও সমাধান চিহ্নিত করেছে।
কমিশনার ড. শাকিরা চুনারা বলেন, ‘তরুণরা এক দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে পথ খুঁজছে। এই কমিশনের মাধ্যমে আমরা তাদের বৈচিত্র্যময় ও উদ্বেগজনক অভিজ্ঞতা শুনেছি। তবে সুযোগও রয়েছে। আমরা দেখেছি, তরুণরা ইতিমধ্যেই সক্রিয় নাগরিক হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে, পরিবর্তন আনছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তরুণ নেতৃত্ব যেভাবে নিজ নিজ সমাজ ও বৈশ্বিক পরিসরে পরিবর্তন আনছে, তা আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। আমাদের প্রজন্মে বিনিয়োগ ও তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা গড়লে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব আরও সুস্থ, সচেতন ও সক্ষম হবে।’