সালমান শাহ হত্যার ঘটনা স্বীকার করে রাজসাক্ষী হতে চেয়ে অন্যতম আসামি রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
স্বীকারোক্তিতে তিনি জানান, সালমান শাহকে খুনের জন্য সামিরার মা ডনকে ১২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেন। হত্যার আগে ৬ লাখ ও পরে ৬ লাখ। তিনি হত্যার আগে ৬ লাখ টাকা দেন।
শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) আদালত সূত্রে এ জবানবন্দির তথ্য জানা গেছে।
সালমান শাহ হত্যার মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ সালমান শাহর ভাই বিল্টুকে অপহরণের পরিকল্পনা করে ডন ও ডেভিড। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই গ্রেপ্তার হন রিজভী আহমেদ। পরে সালমান শাহ হত্যার ঘটনায় ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি।
জবানবন্দিতে বলেন, ৯০ দশকের প্রথম দিকে রিজভী মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতেন এবং ছবি দেখার জন্য এফডিসিতে যেতেন। একসময় অভিনেতা ডনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। পরে ডেভিড, ফারুকের সঙ্গেও তার পরিচয় হয়। ডন সালমান শাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। সালমানের স্ত্রী সামিরার সঙ্গে ডনের গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং দৈহিক সম্পর্কও ছিল। সামিরার মায়ের সঙ্গে চিত্র প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গোপন ও দৈহিক সম্পর্ক ছিল। সালমান ডনকে এড়িয়ে চলতেন।
১৯৯৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে গুলিস্তানের বারে সালমান শাহ হত্যার প্রস্তুতি নিয়ে রিজভী এফডিসিতে যায়। ডনকে না পেয়ে ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করে। পরে ডনকে পান। রাত ৮টায় ডন, ডেভিড, ফারুক, জাভেদ ও রিজভী গুলিস্থানের কাছে একটা বারে যায়। সেখানে টেলিফোনে আরও ২ জন ছেলে ছাত্তার ও সাজুকে আসতে বলে। তারা কিছুক্ষণ পরে আসে। ফারুক ২ লাখ টাকা বের করে বলে, ছামিরার মা টাকা দিয়েছে। সালমানকে শেষ করার জন্য মোট ১২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কাজের আগে ৬ লাখ ও কাজের পরে ৬ লাখ। কিন্তু ২ লাখ টাকা পেয়ে ডনের সঙ্গে ফারুক কথা কাটাকাটি হয়। পরে ফারুক ২০/২৫ মিনিট পরে আরও ৪ লাখ টাকা নিয়ে আসে। গুলিস্তানের বারে ডন প্লাস্টিকের দড়িটা দুই টুকরো করে। এক টুকরা নিজের মাজায় বেঁধে কালো জ্যাকেট গায়ে দেয়। বাকি অর্ধৈক রশি ফারুকের কাছে দেয়। টাকা, সিরিঞ্জ, রিভলভার ইত্যাদি তারা গুছিয়ে নেয়। ছামিরার মা ও আজিজ মোহাম্মদ ভাই দুজনে মিলেই সালমানকে শেষ করার জন্য ডন ও ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
ফজরের আজানের আগে সালমান শাহ খুন হন! ওই দিন গুলিস্তানের বার থেকে তারা এফডিসিতে যান। সেখানে শুটিং শেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত আড়াইটার সময় বের হন। রিজভী ডনকে জিজ্ঞেস করে, আমি চলে যাবো? ডন তাদের সঙ্গে যেতে বলে। পরে গাড়ি ড্রাইভ করে ডন ইস্কাটনের সালমানের বাসার সামনে গাড়ি থামায়। ডন-ডেভিড ও ফারুক পূর্ব পরিচিত হওয়ায় দারোয়ান কিছু বলে নাই। সালমানের বাসায় লিফ্ট এ উঠার আগেই রুবী নামে একজন মেয়ের দরজায় নক করে ডন।
রুবী নাইটি পড়া অবস্থায় দরজা খোলে ও বলে, ‘তোমরা এসছো।’ ডন রুবীকে বলে, ‘আজিজ ভাই কোথায়’? বাথরুম থেকে আজিজ ভাই বের হয়ে আসে ও সবাই একত্রে (রুবি ছাড়া) লিফটে উঠে। আজিজ ভাই ৪ তলায় নেমে যায় এবং অন্যান্যরা ১১ তলায় নেমে সালমানের বাসায় যায়। সালমানের দরজা আগে থেকেই চাপান ছিল। দরজা খুলেই দেখা যায়, সালমান বেডরুমে শুয়ে আছে, ছামিরা সেখানে নাই। ডন, ডেভিড, জাভেদ, ফারুক সালমানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ফারুক তার পকেট থেকে ক্লোলোফরমের শিশি বের করে ছামিরাকে দেয়। ছামিরা সেটা দিয়ে সালমানের নাকের ওপর চেপে ধরে। ডন সালমানের বুকের ওপর বসে। ফারুককে বলে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে ডাক। ফারুক বাইরে গিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে নিয়ে আসে। ছামিরার মা ড্রেসিংরুম থেকে বের হয়ে আসে। তখন ধস্তাধস্তি হচ্ছিলো। সালমানের খুব শক্তি ছিল, ইনজেকশন দেওয়া যাচ্ছিল না। তখন সবাই মিলে সালমানকে ড্রেসিং রুমে নিয়ে সালমানের পা বাঁধে। আজিজ ভাই ডনকে ইনজেকশন দিতে বলে। সিরিঞ্জটাতে কোনও ঔষধ বা কিছু ছিল না। ছামিরা পুশ করে, তার মা ছামিরাকে পুশ করতে সাহায্য করে। পরে সালমান নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ইনজেকশন পুশ করার আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাই সালমান শাহের ঘাড়ের ওপর ফ্যান ছুঁড়ে মেরেছে। ড্রেসিং রুমে একটা মই ছিল। আজিজ মোহাম্মদ ভাই রিজভীকে মই আনতে বলে। মই আনার পর ডনের কোমরের দড়ি নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাই নিজেই বই দিয়ে উঠে দড়িটিকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে বাঁধে। রিজভী, সামিরা, সামিরার মা সাহায্য করে। পরে সালমানের পায়ে বাঁধা রশি খুলে বুকের ওপর উঠে গলায় চাপ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখে যে নিশ্বাস নেই। রশিটা কিছুটা ঝুলিয়ে রাখা হয়, যাতে দেখানো যায়, লাশটাকে ঝুলানো থেকে খোলা হয়েছে। এর আগে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘরে ঢুকেই কাজের মেয়ে ও একটা ছেলেকে আলাদা আলাদাভাবে ড্রয়িং রুমে ও বাথরুমে আটকিয়ে রাখা হয়। পরে সালমান সুইসাইড করেছে এটা দেখানোর জন্য তেল মালিশ করা হয়। কাপড় ভিজিয়ে শরীরে রাখা হয়। পরে সামিরার মা চট্টগ্রাম চলে যাবে এমন পরিকল্পনাও হয়।
পরে পেছনের গেট দিয়ে সবাই বেরিয়ে যায়। গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়েন। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে নামার পর ফজরের আজান হয়। পরে রিজভী ফরিদপুর চলে যায়।
পরের বছর ৪ জুলাই ডন ও ডেভিড রিজভীদের ফরিদপুরের বাড়িতে যান। পরে ফরিদপুরের একটা আবাসিক হোটেল সুগন্ধায় বসে আলাপ করেন। ডন বলে, ‘মামলাটা আবার নাড়া দিয়ে উঠেছে। যেহেতু আমাদের সঙ্গে ছিলে এখন আমাদের সাহায্য করতে হবে।‘ পরিকল্পনা হয়, রিজভী প্রয়াত চিত্র পরিচালক আলমগীর কবিরের ছেলে লেনিন সেজে সালমানের বাবা-মার বাসায় যাবে এবং সালমানের ছোট ভাই বিল্টুকে অপহরণ করবে। সালমানের হত্যা মামলা প্রত্যাহার করতে তার বাবা মা-কে চাপ সৃষ্টি করবে। আলমগীর কবির রিজভীর মামা। আলমগীরের মৃত্যুর আগে আগে লেনিন সালমানদের বাসায় বেশ কিছু দিন ছিল। রিজভী জানতেন, লেনিন কলকাতা থাকে। মূলত লেনিন তখন লন্ডনে থাকতেন।
১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই সালমানের বাবা-মার বাসায় যান রিজভী। তাদের পরিকল্পনা ছিল, বিকাল ৫টায় ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বিশ্বরোডের রেল ক্রসিংয়ের কাছে বিল্টুকে নিয়ে যাবে এবং বাসায় ফিরবে। ডন, ফারুক, জাভেদ সবাই তাদের ফলো করবে। বাসা চিনে আসবে। রাত দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে রিজভী দরজা খুলে দিলে বিল্টুকে অপহরণ করে সবাই চলে যাবে। মিরপুর ১১-এর এক বস্তিতে ১৮ থেকে ১৯ বছরের বিল্টুকে রাখার কথা ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ সেপ্টেম্বর বাড়ি থেকে রওনা দেয় রিজভী। পরের দিন ঢাকায় পৌঁছে বিন্টুদের বাসায় যান। লেনিন বলে পরিচয় দিয়ে বাসায় গেলে সালমান শাহর বাবা-মা রিজভীকে সন্দেহ করে পুলিশে দেয়। পরে পুলিশ এসে আমাকে গ্রেফতার করে।