শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫
শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
অপরাধ

আতিকের সান্নিধ্যে সাচ্চুর নজিরবিহীন টেন্ডারবাজি

গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চু। কার্যত নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ছিলেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনে টেন্ডারবাজি ছিল তার আয়ের প্রধান উৎস। করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আতিকুল ইসলামের সান্নিধ্য পেয়ে সাচ্চু ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। ক্ষমতার প্রভাবে নজিরবিহীন সব কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি।

দলীয় পদ তাকে বেশুমার ক্ষমতাশালী করে। তার ক্ষমতার পারদ কতটা শক্তিশালী ছিল, এর সন্ধান মেলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে। তিনি ইজারামূল্য বকেয়া রেখে মহাখালী বাস টার্মিনাল ইজারা পেয়েছিলেন, যা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। টেন্ডারবাজির এ টাকায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত লং আইল্যান্ডের ফ্লোরাল পার্কে স্ত্রীর নামে বাড়ি কিনেছেন। বাড়িটির দাম ৭ লাখ ৬৫ হাজার ডলার। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চুর স্ত্রী আক্তার ইয়ানুরের নামে বাড়িটি রেজিস্ট্রি করা হয়। নথিপত্রে দেখা যায়, রহমান আতিক নামে আরেক বাংলাদেশিকে লোকাল অভিভাবক রাখা হয়েছে। তিনি ৮৬-১৬০ এলমহার্স্ট অ্যাভিনিউ, এনওয়াই-১১৩৭৩, ঠিকানার বর্তমান বাসিন্দা। ফ্লোরাল পার্কের ১৯৩ লয়েল অ্যাভিনিউ, এনওয়াই-১১০০১নং বাড়িটি কিনতে প্রথমে ২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর ৭ লাখ ৬৫ হাজার ডলারে বায়নাপত্র করা হয়। ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে রেজিস্ট্রি করে নেন আক্তার ইয়ানুর। নিউইয়র্কে বাড়ি কেনার বিপুল পরিমাণ ডলারের উৎস সম্পর্কে গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চুর বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার স্ত্রী আক্তার ইয়ানুরের ফেসবুক মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

ক্ষমতার প্রভাব : তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি থাকা অবস্থায়ই ক্ষমতার অবৈধ প্রভাব খাটাতে শুরু করেন সাচ্চু। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আগের ইজারামূল্যের টাকা বকেয়া রেখেই দ্বিতীয়বার মহাখালী বাস টার্মিনাল ইজারা পেয়েছিলেন তিনি। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় (ভ্যাট-আয়করসহ ৪ কোটি ৬২ লাখ) মহাখালী বাস টার্মিনালের ইজারা গাজী রাইয়ান এন্টারপ্রাইজকে দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। প্রতিষ্ঠানটির মালিক গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চু। এক বছর মেয়াদি ওই ইজারা শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে মেয়াদ তিন মাস বাড়ানোর আবেদন করেন ইজারাদার। আবেদন অনুযায়ী ঠিকাদারকে ওই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়। ২০২২ সালের এপ্রিলে আগের ইজারামূল্যের বিনিময়েই সাচ্চুর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরও এক বছরের জন্য ইজারা চুক্তি নবায়ন করে সিটি করপোরেশন। তবে এ দফায় তিনি ঠিকমতো ইজারার টাকাও পরিশোধ করেননি। ইজারার নির্ধারিত মেয়াদ ২০২৩ সালের এপ্রিলের মধ্যে তিনি ২ কোটি ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। সেই হিসাবে বকেয়া ছিল ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এভাবে চুক্তি লঙ্ঘন করার পরও সাচ্চুর সেই প্রতিষ্ঠানের কাছেই আরও এক বছরের জন্য (২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত) বাস টার্মিনালটির ইজারা দেওয়া হয়। নতুন ইজারার কার্যাদেশ দেওয়া হয় ১২ মার্চ (২০২৪)। এ কার্যাদেশ দেওয়ার আগেই তৎকালীন মেয়র আতিকুল ইসলামের নির্দেশে কৌশলে সাচ্চুকে আরও পাঁচ মাস অর্থাৎ মে পর্যন্ত বকেয়া পরিশোধের সময় দেয় সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। এরপর আর সময়ও বাড়ানো হয়নি, টাকাও ফেরত দেননি সাচ্চু। চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে গিয়ে বাড়ি কিনে বসতি স্থাপন করেন। 

জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগ নামধারী কিছু নেতার সহযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে হুন্ডি করে বিপুল পরিমাণ টাকা নিউইয়র্কে নিয়ে এসেছেন সাচ্চু। ২০২৩ সালে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ মারা গেলে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পান গাজী সাচ্চু। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালের ২৭ জুলাই শেখ হাসিনা ভারপ্রাপ্ত থেকে পূর্ণাঙ্গ সভাপতির দায়িত্ব দেন তাকে। এরপরই তার সম্পদের পরিমাণ অস্বাভাবিক পরিমাণে বাড়তে থাকে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে তার ছিল একক আধিপত্য। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে একক টেন্ডারে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নিউইয়র্কে বাড়ি কিনে তার অবৈধ সম্পদের জানান দিয়েছেন সাচ্চু। সেখানে বাড়ি কেনার পর যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগসহ নিজ দলের অনেকেই বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। তারা মনে করছেন, সাচ্চুর মতো দুর্বৃত্তদের কারণেই আজ আওয়ামী লীগের এই অবস্থা।

যুক্তরাজ্য ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার ফারুক নেওয়াজ খান যুগান্তরকে বলেন, যেভাবে বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার দেশের বাইরে পাঠানো হচ্ছে তা নির্মূল করা না গেলে আমরা দেউলিয়া হয়ে যাব। দুর্বৃত্ত রাজনীতিক, আমলাসহ যারা উন্নত দেশে সম্পদ গড়েছেন, তাদের তালিকা করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে যোগাযোগ করে এসব সম্পদ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো এরকম দুর্বৃত্ত রাজনীতিক পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কি না, আমার জানা নেই। চোখের সামনে আওয়ামী লীগের যে নেতাকে রিকশায় চড়ে শেখ হাসিনার ধানমন্ডির অফিসে আসতে দেখেছি, ক্ষমতায় যাওয়ার পর ওই রাজনীতিককে ল্যান্ড ক্রুজার চড়তে দেখে বিস্মিত হয়েছি। তিনি আরও বলেন, ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, এটা বড় বিষয় নয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল এই ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের কতজন কত টাকার মালিক হয়েছেন, তার হিসাব নিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা। এটা যদি তিনি করতে পারতেন, তাহলে ক্ষমতা ছেড়ে আজ তাকে দেশান্তরী হতে হতো না।

এই সম্পর্কিত আরো