গাজীপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে সাংবাদিক মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে। একই দিনে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে মারধর এমনকি ইট দিয়ে থেঁতলে নির্যাতন করা হয় আরেক সাংবাদিককে। রাজধানীর পাশে দেশের সর্ববৃহৎ এ নগরীতে প্রকাশ্য এমন বেপরোয়া ঘটনায় উদ্বিগ্ন সচেতন নাগরিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ।
সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডের পরপরই চাঁদাবাজির বিষয়টি চাউর হয়। বলা হয়, চাঁদাবাজির প্রতিবেদন করায় তাকে হত্যা করা হয়েছে। সত্যিই কি চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ড। ঘটনার সুলোক সন্ধানে জানা গেছে, ঘটনাটি সেরকম নয়। মূলত হানিট্র্যাপ থেকে ঘটনার সূত্রপাত। যে ঘটনার ভিডিও করায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তুহিন।
এদিকে, তুহিন হত্যার ঘটনায় পাঁচজন সন্দেহভাজনকে আটক করেছে পুলিশ। খুনে তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে, সাংবাদিক তুহিনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার (৮ আগস্ট) ময়নাতদন্তে শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
নিহত তুহিন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। পাশাপাশি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করতেন। সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি।
তুহিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের বড় ভাই মো. সেলিম বাদী হয়ে শুক্রবার (৮ আগস্ট) সকালে বাসন থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে ২০ থেকে ২৫ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে।
নিহতের বড় ভাই মো. সেলিম ও স্থানীয়রা জানান, গাজীপুর মহানগরীর বাসন থানাধীন চান্দনা গ্রামের শহীদ রওশন সড়ক এলাকার ভাড়া বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকেন তুহিন। বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) রাতে তিনি চান্দনা চৌরাস্তা থেকে বাসার দিকে রওনা হয়েছিলেন। এ সময় ছয় থেকে সাত জন যুবক ধারালো দা ও চাপাতি নিয়ে তাকে জনসম্মুখে ধাওয়া করে। তিনি প্রাণ রক্ষার জন্য দৌড়ে ঈদগাহ মার্কেটের একটি দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়েন। সন্ত্রাসীরা সেখানে গিয়ে তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রকাশ্যে এলোপাতাড়ি কোপায়। এতে তার গলার কিছু অংশ কেটে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত হয়। ঘটনাস্থলেই তুহিনের মৃত্যু হয়। দুর্বৃত্তরা ঘটনার পর বলদর্পে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
ওই সময় স্থানীয় কলকারখানা ছুটি হওয়ায় আশেপাশে বহু লোকজন উপস্থিত থাকলেও সন্ত্রাসীদের ভয়ে ধারালো অস্ত্রের সামনে তুহিনকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি।
ঘটনার কিছু সময় আগে একইসঙ্গে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি দোকানে বসে সময় কাটাচ্ছিলেন তুহিন ও তার সহকর্মী মো. শামীম হোসেন। ওই সময়কার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাংবাদিক শামীম বলেন, ‘আমরা দুজন হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় এক নারী আরেক পুরুষ আমাদের অতিক্রম করে যায়। কয়েকজন লোক দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে বলতে থাকে, এ পাইছি তোরা আয়। এ সময় তারা রামদা বের করলে ওই লোকটা দৌড় দেয়। ঠিক ওই সময় ওরাও ধারালো অস্ত্র নিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে দৌড় দেয়। তখন আমার পাশ থেকে তুহিন ওদের পেছনে দৌড় দেন।
তিনি আরও বলেন, এরপর তুহিনকে আমি আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে আমি তাকে খুঁজতে এগিয়ে যাই। তখন আমি দেখি যারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তারা হঠাৎ থেমে গিয়ে পেছনে তাকায়। ওই সময় তুহিন ভিডিও করছিলেন। সশস্ত্রধারীরা পেছনের দিকে এসে তুহিনকে ধাওয়া দেয়। তিনি তখন দৌড়ে চায়ের দোকানে ঢুকে যান। ঠিক ওই মুহূর্তে ওরাও চায়ের দোকানে ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। তখন আমি চৌরাস্তা এলাকায় পুলিশের গাড়ি খুঁজতে থাকি। কোনো গাড়ি দেখতে না পেয়ে আমি বাসন থানার ওসিকে ফোন করি। কিছু সময় পর ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে।
কীভাবে ঘটনার সূত্রপাত
পুলিশ বলছে, ঘটনাটির সূত্রপাত হয় হানি ট্র্যাপ থেকে। এক নারীর পক্ষ হয়ে কয়েকজন সশস্ত্র যুবক বাদশা মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে মারধর করছিল। তখন সেখান দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন তুহিন। মারধরের বিষয়টি দেখে তিনি তা ভিডিও ধারণ শুরু করেন। বিষয়টি টের পেয়ে সশস্ত্র যুবকরা তুহিনকে পাকড়াও করে। তাকে ধারণ করা ভিডিও মুছে ফেলতে বলে। কিন্তু তুহিন এতে অস্বীকৃতি জানানোয় তার ওপর হামলা চালানো হয়।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (ক্রাইম) রবিউল হাসান শুক্রবার বলেন, সিসি টিভির ফুটেজ পর্যালোচনা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে দেখা যায়, সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তি চান্দনা চৌরাস্তা মোড়ে এক নারীর সঙ্গে বিবাদে জড়ায়। বাদশা মিয়া নারীকে আঘাত করার পর একদল দুর্বৃত্ত নারীর পক্ষ নিয়ে ধারালো চাপাতি হাতে বাদশা মিয়াকে আঘাত করে। এ সময় বাদশা মিয়া দৌড়ে পালিয়ে যায়। আর এ ঘটনাটি রাস্তার পাশ থেকে মোবাইল ফোনে ভিডিও করছিলেন সাংবাদিক তুহিন। সন্ত্রাসীরা তুহিনকে দেখে ফেলে ভিডিও মুছে ফেলতে বলে। তুহিন ভিডিও মুছতে অস্বীকার করলে সন্ত্রাসীরা তাকে ধাওয়া দেয়। একপর্যায়ে তুহিন দৌড়ে পালাতে থাকে সন্ত্রাসীরাও তুহিনের পিছু নিয়ে ধাওয়া করে। চান্দনা চৌরাস্তার মসজিদ মার্কেটের সামনে একটি দোকানের কাছে সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে তুহিনের মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়।
পুলিশ বলছে, এটি কোনো চাঁদাবাজির ঘটনা নয়। যে নারীটির সঙ্গে বাদশা মিয়ার বিবাদ হয় সে নারীর নাম গোলাপী। তিনি একজন কলগার্ল। গোলাপী মানুষের সঙ্গে কৌশলে সম্পর্ক তৈরি করে পরে ফাঁদ পেতে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে সব লুটে নেয়।
বাসন থানার ওসি শাহীন খান বলেন, ‘সিসিটিভির ফুটেজ ও ক্লু সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে খুনিদের শনাক্তের চেষ্টা করছি।’
জিএমপি কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন সম্পন্ন হয়েছে। থানায় মামলা হয়েছে। আমি সিরিয়াসলি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।
তুহিনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ঘেটে দেখা গেছে, চাঁদাবাজি সম্পর্কিত কোনো লাইভ, ভিডিও বা কোনো রিপোর্ট তার ফেসবুক ওয়ালে নেই। তিনি চান্দানা চৌরাস্তা এলাকার বিভিন্ন সমস্যা ও মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে পোষ্ট করতেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে তিনি চান্দনা চৌরাস্তার এক মিনিট ৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও আপলোড করেন। এতে লেখা রয়েছে, ‘যেমন খুশি তেমন রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য’। এর কিছু সময় আগে তিনি আরও দুটি ছবি ও ভিডিও আপলোড দেন।
এদিকে সাংবাদিক হত্যার প্রতিবাদে গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে একটি বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন সাংবাদিক ইউনিয়ন গাজীপুরের সভাপতি এইচ এম দেলোয়ার হোসেন। বক্তব্য রাখেন গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শাহ সামসুল হক রিপন প্রমুখ।