আলু রাখতে হিমাগারে যান চরশেরপুর এলাকার কৃষক পারভেজ মিয়া। কিন্তু শনিবার (৮ মার্চ) দুপুর থেকে সোমবার (১০ মার্চ) বিকেল ৫টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও হিমাগারে আলু রাখতে না পেরে ফিরে যান তিনি।
পারভেজ বলেন, বিএডিসির আলুবীজ কিনে বেশ ভালো ফলন হলেও হিমাগারে জায়গা না পাওয়ায় সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। দুদিন ধরে আলুর জন্য গাড়ি ভাড়া করে এনে বসিয়ে রাখছি, এখন কম দামে বেচে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
শেরপুরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আলুর উৎপাদন হলেও পর্যাপ্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন কৃষকরা। সরকারি দুটি ও একটি বেসরকারি হিমাগারে জায়গার সংকট দেখা দেওয়ায় বহু কৃষক বাধ্য হয়ে কম দামে আলু বিক্রি করছেন। এতে কৃষকদের লোকসানের পাশাপাশি যানজটের সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এবার শেরপুরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫ হাজার ২১২ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু কৃষকরা আরও বেশি জমিতে আলু আবাদ করায় ৫ হাজার ৩১৭ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। ফলে ৯৩ হাজার ৮১৬ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এবার ফলন হয়েছে ৯৫ হাজার ৭০৬ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৮৯০ টন বেশি।
কৃষকদের অভিযোগ, অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে সংরক্ষণের জন্য হিমাগারে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় অনেকেই আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে তারা কম দামে আলু বিক্রি করছেন, যা চাষাবাদের খরচও তুলতে পারছে না।
শনিবার দুপুরে নালিতাবাড়ী উপজেলার কৃষক আব্দুল মতিন আলু নিয়ে হিমাগারে এলেও জায়গা পাননি। তিনি বলেন, আমার ৫০ বস্তা আলু সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনদিন ধরে ঘুরেও হিমাগারে জায়গা পাইনি। গাড়ি ভাড়া দিয়েও অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে, এখন মনে হচ্ছে কম দামে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই।
শেরপুর সদর উপজেলার চরশেরপুর এলাকার কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, বুকিং কার্ড নিতে গিয়ে দেখি সব শেষ। ব্যবসায়ীরা আগেই কার্ড সংগ্রহ করেছে। সাধারণ কৃষকরা হিমাগারে জায়গা না পেয়ে লোকসানের মুখে পড়েছে।
নকলা উপজেলার কৃষক জসিম উদ্দিন বলেন, গতবছর হিমাগারে জায়গা পেয়েছিলাম, কিন্তু এবার অতিরিক্ত চাষ ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে আলু রাখতে পারছি না। হিমাগারে রাখতে পারলে অন্তত দামটা ভালো পাওয়া যেত। এখন ৪০০ টাকা মণ দামে বিক্রি করতে হচ্ছে, যা চাষের খরচও উঠছে না।
শ্রীবরদী উপজেলার কৃষক মো. শাহজাহান বলেন, বছরের পর বছর আমরা হিমাগারের সংকট নিয়ে ভুগছি। প্রতি বছরই ব্যবসায়ীরা আগে কার্ড নিয়ে নেয়, আর আমরা কৃষকরা হিমাগারের সামনে পড়ে থাকি। এবারও তাই হলো। কয়েকদিন ধরে আলু বোঝাই করে রাস্তায় বসে আছি, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না।
শেরপুরে সরকারি দুটি হিমাগার রয়েছে, যেখানে যথাক্রমে ১ হাজার ও ২ হাজার টন করে মোট ৩ হাজার টন আলু সংরক্ষণ করা সম্ভব। কিন্তু এবারের উৎপাদনের তুলনায় এটি খুবই কম। এছাড়া জেলার একমাত্র বেসরকারি হিমাগার তাজ কোল্ড স্টোরেজে ১০ হাজার টন আলু সংরক্ষণের সুযোগ থাকলেও হিমাগারে প্রচণ্ড চাপ পড়ায় কৃষকরা জায়গা পাচ্ছেন না।
তাজ কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি কৃষকদের সেবা দিতে। তবে ধারণক্ষমতার তুলনায় চাহিদা বেশি থাকায় অনেক কৃষককে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সরকারি হিমাগারে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণের খরচ ৬ টাকা ৭৫ পয়সা, আর বেসরকারি তাজ কোল্ড স্টোরেজে ৫ দশমিক ৮১ টাকা খরচে প্রতি কেজি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে। তবে সরকারি হিমাগারে জায়গার সংকট ও বেসরকারি হিমাগারে অতিরিক্ত চাপের কারণে অনেকেই আলু সংরক্ষণ করতে পারছেন না।
হিমাগারে জায়গা না পেয়ে অনেক কৃষক ট্রলি ও ট্রাকে আলু বোঝাই করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন। ফলে শেরপুর জেলা শহর থেকে উপজেলা শহরগুলোর সংযোগ সড়কগুলোতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। শেরপুর-শ্রীবরদী, শেরপুর-বকশীগঞ্জ, রৌমারী-কুড়িগ্রাম আঞ্চলিক সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলার কৃষক হেলাল উদ্দিন বলেন, তিনদিন ধরে আলু বোঝাই ট্রাক নিয়ে হিমাগারের সামনে বসে আছি। জায়গা মিলছে না, আবার বাড়িও নিতে পারছি না। এখন বাজারে কম দামে বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
শেরপুর খামারবাড়ির উপপরিচালক কৃষিবিদ শাখাওয়াত হোসেন বলেন, শেরপুরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আলুর উৎপাদন হওয়ায় হিমাগারে সংরক্ষণের চাপ বেড়েছে। কৃষকরা যাতে ক্ষতির মুখে না পড়েন, সেজন্য স্বল্প মেয়াদে ২-৩ মাস বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করতে পারেন। তবে দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণের জন্য হিমাগারে রাখা জরুরি।
তিনি আরও বলেন, শেরপুরে সবজি উৎপাদনও উদ্বৃত্ত হয়। এজন্য সবজির জন্য একটি নতুন হিমাগার নির্মাণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিবেদন জমা হয়েছে, যা বাস্তবায়ন হলে কৃষকদের এই দুর্ভোগ অনেকটাই কমে যাবে।
শেরপুর বিসিকের উপব্যবস্থাপক বিজয় কুমার দত্ত বলেন, শেরপুরের একমাত্র বেসরকারি হিমাগারটি আমাদের বিসিকের ভেতরেই। আমরা বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি নতুন কোল্ড স্টোরেজ করতে আগ্রহী হয়, আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো।