চট্টগ্রাম নগরীর হারিকেন ফ্যাক্টরি এলাকার পরিচ্ছন্নতাকর্মী আনোয়ারা বেগম। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে রাস্তাঘাট, অলিগলি, ফ্লাইওভারের নিচে পড়ে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য কুড়িয়ে।
বছর দুয়েক আগেও তাঁর জীবনে ছিল শুধুই টানাপোড়েন—পরিশ্রমের বিনিময়ে মজুরি ছিল সামান্য। খাবার জুটত না ঠিকমতো, চিকিৎসা ছিল বিলাসিতা, আর সন্তানদের পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছিল। সেই আনোয়ারার জীবনে মোড় এনে দিয়েছে ২০২২ সালে শুরু হওয়া ‘টেকসই প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্প। জীবনের ভার কমেছে এবং সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতার আশা। তিনি বলেন, ‘আমার আয় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে পারি, আর সন্তানদের পড়াশোনায় বাধা কমে গেছে।’
এই পরিবর্তনের পেছনে যে কাঠামো, তার কেন্দ্রে রয়েছে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ভাঙারিওয়ালাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক ক্ষমতায়ন। প্রকল্পটির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছেন প্রায় ৩ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ২০০ জনের বেশি ভাঙারিওয়ালা। যাঁরা একসময় অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে বঞ্চিত ছিলেন নিয়মিত আয়, সুরক্ষা ও স্বীকৃতি থেকে; তাঁরা এখন সামাজিক নিরাপত্তা, ব্যাংকিং ও সঞ্চয়ের আওতায় এসেছেন। ভাঙারিওয়ালাদের দেওয়া হয়েছে ট্রেড লাইসেন্স; পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরবরাহ করা হয়েছে নিরাপত্তা উপকরণ—গ্লাভস, মাস্ক ও বুট। সবচেয়ে বড় অগ্রগতি ১ হাজার ৮০০-এর বেশি কর্মী এখন গ্রুপ ইনস্যুরেন্সের আওতায়, যা বর্জ্যের মধ্যেও তাঁদের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে এবং নিয়মিত আয়কে করেছে নিশ্চিত ও সম্মানজনক।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ এবং ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা)। আনোয়ারার জীবনে যে রূপান্তর এসেছে, তা ছড়িয়ে পড়েছে শহরের আরও ৪১টি ওয়ার্ডে—পাহাড়তলী, বাংলাবাজার, জিইসি মোড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকায়। শুধু আয় নয়, এই প্রকল্প নগরবাসীর মধ্যেও পরিবেশ সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। নগরীর ৫ লাখের বেশি মানুষ এখন প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে সচেতন। বিশেষ করে ৭১টি স্কুলের প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থী ঘরে ঘরে গিয়ে পরিবেশবান্ধব আচরণের শিক্ষা দিচ্ছে। এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা পরিবেশ রক্ষায় হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের দূত।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. মাসরুর রিয়াজ মনে করেন, এই প্রকল্প প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন মডেলে রূপান্তর করেছে, যা গ্রিন জব ও মাইক্রো উদ্যোক্তা তৈরি করে স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা করতে পারে।
সরকারের ২০৩০ সালের প্লাস্টিক উৎপাদন কমানোর লক্ষ্য অনুযায়ী এই প্রকল্প ইতিমধ্যে পুনর্ব্যবহার করেছে ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য। একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হয়েছে, তেমনি নগরীর অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে নতুন প্রাণ। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এখন শুধু পরিবেশের নয়, অর্থনীতিরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ড্রেনেজ ব্যবস্থায় আগের মতো প্লাস্টিক জমে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে না। অনেক ড্রেন এখন সচল, আর যেগুলোয় বর্জ্য জমছে, তা পরিচ্ছন্ন করছেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। হালিশহর ডাম্পিং ইয়ার্ডে পাঠানো এই বর্জ্য থেকেও প্রকল্পের কর্মীরা আলাদা করে প্লাস্টিক সংগ্রহ করছেন, বিক্রি করছেন ভাঙারি দোকানে, আর সেখান থেকে যাচ্ছে রিসাইক্লিং কারখানায়—শহরের বর্জ্যই এখন ঘুরছে এক টেকসই অর্থনৈতিক চক্রে।
দেশে ইপসার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মো. আরিফুর রহমান বলেন, ‘আমরা শুধু পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করিনি, বরং তাঁদের সামাজিক ও আর্থিক ক্ষমতায়নের পথও খুলে দিয়েছি। এখন তাঁদের মধ্যে নেতৃত্ব গড়ে উঠছে।’
ইউনিলিভার বাংলাদেশের ডিরেক্টর—করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপস অ্যান্ড কমিউনিকেশনসের প্রধান শামিমা আক্তার বলেন, ‘এ উদ্যোগটি আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির অংশ। আমরা দেখেছি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এখন শুধু কাজ করছেন না, তাঁরা আত্মবিশ্বাসী ও ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন।’
এই পরিবর্তন শুধু পরিসংখ্যান নয়, জীবনের বাস্তব গল্প। পরিচ্ছন্নতাকর্মী সাদেক আলী বলেন, ‘আগে দিনে যা পেতাম, তা দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল ছিল। এখন মাসে ১২-১৪ হাজার টাকা আয় করি। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাই। মাথায় একটা পরিকল্পনা এসেছে—একটু সঞ্চয় করব।’
ভাঙারিওয়ালা আব্দুল মালেক বলেন, ‘আগে পুলিশের ভয় ছিল, কেউ চাইলেই মাল নিয়ে যেত। এখন লাইসেন্স আছে, পুলিশও কিছু বলে না। ইউনিফর্ম পরেই কাজ করি। ব্যাংকে টাকা রাখি। ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যবসার পরিধিও বাড়িয়েছি।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আই ইউ এ চৌধুরী, কমান্ডার (এস), বিএন বলেন, এই প্রকল্প শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নয়, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মর্যাদা ও কর্মনিরাপত্তার দিক থেকেও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে এর কলেবর আরও বৃদ্ধিসহ সলিড বর্জ্যের দিকে মনোযোগ এলে ভালো হয়।
এই সমন্বিত মডেল প্রমাণ করেছে—যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যার কার্যকর সমাধান, সেখানেই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ে ওঠার বিশাল সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। বর্জ্য আর শুধু ফেলনা নয়, তা এখন জীবিকারও শক্ত ভিত।