দেশে বেড়েই চলছে ঋণ খেলাপি। শেষ ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আর মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায়। একই সময়ে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৩০ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।
গত রোববার খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, পাঁচ কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
সেগুলো হলো— মেয়াদি ঋণখেলাপির সময় পুনর্নির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে কিছু বড় অঙ্কের ঋণ বিরূপমানে শ্রেণিকৃত হওয়া, গ্রাহকের চলতি ঋণ নবায়ন না হওয়া, পুনঃতফশিল করা ঋণের কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধ না হওয়া এবং বিদ্যমান খেলাপি ঋণের ওপর সুদ যোগ হয়ে বেড়েছে খেলাপি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ঋণস্থিতি ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত যা ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এর মানে শেষ তিন মাসে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৩০ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। যেখানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যেখানে খেলাপি দেখানো হয়েছিল মাত্র ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এর মানে, ১৫ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। আর সরকার পরিবর্তনের আগে গত জুন শেষে খেলাপি ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। সে তুলনায় বেড়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। শেষ ৯ মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ সময়ে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয়। এর অন্যতম কারণ বিগত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে ঋণের নামে বিপুল অর্থ লুট করা হয়। সেই টাকা আর ফেরত আসছে না। দখল করা কোনো কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এখন ৯৮ শতাংশে ঠেকেছে। একসময় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের যেখানে ৫ শতাংশের কম ছিল খেলাপি। চলতি বছরের মার্চ শেষে বেসরকারি ব্যাংকের ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এসব ব্যাংকের মোট ঋণের যা ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা বা ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। আর বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা, যা ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৩ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা বা ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ ঋণ খেলাপি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীর্ষ ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্ধ করতে হবে। তাদের বিচারে গঠন করতে হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। অন্যথায় ব্যাংক খাত কখনোই ঠিক হবে না।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। আসলে তারা কী ভাবছে, ঠিক বুঝতে পারছি না। দীর্ঘদিন বলে আসছি, শীর্ষ ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দ করতে হবে। তাদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠাতে হবে। জেলের ভাত না খেলে তারা ঠিক হবে না। এর আগে একটা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে। সে ট্রাইব্যুনালের আওতায় প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির বিচার করতে হবে।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বাড়তির এ ধারা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।’ তার ধারণা, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৮ লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত ছুঁতে পারে। কারণ, ঋণখেলাপিরা আগে যেসব সুযোগ-সুবিধা পেত, সেটা এখন বন্ধ। তাছাড়া এখন লুকানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। যা আছে সবই প্রকাশ পাবে।
ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণের বড় একটা অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সেটা ফেরতে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বিদেশে কিছু সম্পদ জব্ধ হয়েছে, আরও হবে। এটাও ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অংশ। এছাড়া কয়েকজন বড় খেলাপি গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন, বাকিরা পলাতক। তাদের দেশে থাকা সম্পদ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্টরা কাজ করছে।’
খেলাপি ঋণ যে এভাবে লাফিয়ে বাড়বে, তা আগেই ধারণা দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গত আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পরই তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ অনেক বাড়বে। আগের সেই কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। কোনো তথ্য লুকিয়ে রাখা হবে না। তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর এটা আবার কমবে। এছাড়া নতুন করে বিতরণ করা ঋণ যেন খেলাপি না হয়, সেজন্য বিভিন্ন আইনি কঠোরতা আনা হচ্ছে।
বিগত সরকারের সময় নানান নীতিসহায়তার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কম দেখানো হতো। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর সংস্থাটি নীতিসহায়তা তুলে দেওয়ার শর্ত দেয়। বিশেষ করে মেয়াদি ঋণ অনাদায়ি থাকার ৬ মাস পর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ হিসাব করার বিধান বাতিল এবং ঋণ পরিশোধ না করেও নিয়মিত দেখানোর সুযোগ বন্ধ করতে বলে সংস্থাটি। এর মধ্যে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতন হয়।
বিভিন্ন জালিয়াতি করে ঋণের নামে বিপুল অর্থ বের করে নেওয়া শীর্ষ ঋণগ্রহীতাদের বেশির ভাগই এখন পলাতক। কেউ কেউ গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন। এসব কারণেই খেলাপি ঋণ লাফিয়ে বাড়ছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। বিগত সরকারের শুরুর দিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রীতিনীতির আলোকে ব্যাংক খাত পরিচালিত হচ্ছিল। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগ থেকে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফশিল চালু হয়। এরপর থেকে নানা শিথিলতায় খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছিল। এক্ষেত্রে কখনো বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতফশিল, কখনো ঋণ ফেরত না দিলেও নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে গিয়ে পুরো ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।