রক্ষক যখন ভক্ষক তখন চা বাগান রক্ষা করবে কে? তারাপুর চা-বাগানের ব্যাবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তীর ছত্রছায়ায় ভূমিখেকোরা বাগানের ভূমি দখলের মহোৎসব চালাচ্ছে। বাগানের ভূমি দখল থেকে অট্টালিকা নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া শতাধিক দোকানপাট নির্মাণ করে বাণিজ্যিকভাবে তা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। চলছে ভূমি বিক্রি, দখল, ইমারত নির্মাণ। অথচ চা বাগানের ভূমি রক্ষায় আদালত থেকে একটি কমিটি করে দেওয়া হলেও বাগান ব্যবস্থাপক সেই কমিটিকে আড়ালে রেখে মন্দিরের উন্নয়ন ও শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার নামে ভূমি বিক্রি করে নিজের উন্নয়নেই ব্যবস্থা করেছেন রিংকু। হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন।
৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর দখলদারিত্বের দায় চাপিয়ে নিজেকে আড়াল কররা ব্যর্থ চেষ্টা করেন ম্যানেজার রিংকু চক্রবর্তী। তবে অভিযোগ আছে ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাদের সাথে মিলেমিশে তারাপুর চা বাগান ধ্বংসে লিপ্ত ছিলেন তিনি। পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওয়বাদুল কাদেরের সাথে তার ছিল সখ্যতা। তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উঠলেই চলে যেতেন ওবায়দুল কাদেরের কাছে। তবে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর রিংকু পুরোদমে বিএনপি সমর্থক সাজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে নিজের অপকর্ম ঢাকতে ধর্না দিতে থাকনে। বর্তমানে বিএনপির কিছু স্থানীয় নেতাদের ম্যানেজ করে তিনি তার অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া ব্যবস্থাপক রিংকুর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের পর স্থানীয় ও জাতীয় একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও এখন তিনি রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তারাপুর চা বাগান অবৈধভাবে দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে বসতি। সেই সঙ্গে চা বাগানের পাশে পাকা ঘর দিয়ে দোকান কোটা ও স্থায়ীভাবে মার্কেট তৈরী করা হয়েছে।
তবে যারা বসতি নির্মাণ করেছেন তারা জানান, বাগান ম্যানেজারের কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের নগদ টাকা দিয়ে জমি কিনে বাড়ি তৈরী করেছেন। কেউ কেউ বলেন, টাকা দিয়ে তারা ৯০ বছরের জন্য বাগানের জায়গা ইজারা নিয়ে বাড়ি তৈরী করেছেন। তাদের অনেকে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে বলেন, বাগান ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তীর কাছ থেকে নগদ অর্থে ভূমির মালিক হয়েছেন। এসব ভূমি বিক্রি করতে অনেকে সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখেছেন। বাগানের শ্রমিকরা আরো জানান, চা বাগানের ভেতর পাগলা ঘ্ন্টা বাজানেরা কোনও অনুমোদন না থাকলেও পান থেকে চুন খসলেই ম্যানেজার রিংকু চক্রবর্তী শ্রমিকদের ভয় দেখাতে পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে দেন।
অনুসন্ধানে করে জানা গেছে, তারাপুর চা বাগান দেবোত্তর সম্পত্তি হওয়ায় দখল হারান শিল্পপতী রাগীব আলী। আদালত থেকে বাগানের দায়িত্ব পান সেবায়েত পঙ্কজ দাস। কিন্তু রাগীব আলী কারাগার থেকে বেরিয়ে রিভিউ করার পর পঙ্কজকে বাদ দিয়ে সেবায়েত পরিবারের একজনকে প্রতিনিধি হিসেবে রেখে আদালত থেকে কমিটি করে দেওয়া হয়। ওই কমিটিতে রয়েছেন জেলা জজ, জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, আইনজীবী সমিতিসহ বিভিন্ন দফতরের একজন করে প্রতিনিধি। কিন্তু কমিটিকে ঘুম পাড়িয়ে একাই অর্থ উপার্জনের লালসে নামমাত্র মূল্যে দখলদারিত্ব চা বাগানের ভূমি বিক্রি করে আসছেন বাগান ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তী। ক্রমশ; বাগানের ভূমি বিক্রি করায় বেহাত হয়েছে তারাপুর চা বাগানের সাড়ে ৩শ’ একর ভূমি। সম্প্রতী কমিটির সদস্যরা বাগান সরেমজিন পরিদর্শনে যান। কিন্তু পরিদর্শনে যাওয়া কর্মকর্তাদের সুন্দর করে বুঝিয়ে চা পাতা উপহার দিয়ে বিদায় করেন বাগান চতুর ব্যবস্থাপক রিংকু।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে বাগানের একাধিক চা শ্রমিক জানান, ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তী চা শ্রমিকদের কল্যাণ ও মন্দিরের নামে বাগানের জায়গা ও গাছ বিক্রি এবং টিলা কেটে নিজেই নিজের উন্নয়ন করেছেন কিন্তু সাধারণ শ্রমিক বা মন্দিরের কোনও উন্নয়ন হচ্ছে না। তারা আরও অভিযোগ করেন রাত পোহালেই বাগানের ভেতর বহিরগতদের আনাগোনা দেখা যায়। চলে মাদক বিক্রি ও সেবন। তা নিয়ে বাগান ব্যবস্থাপকের ভূমিকা নিরব।
ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তী জানান, তারাপুর চা বাগানের ৫শ’ একর জমির মধ্যে ১৩০ একর ধরে রাখতে পারছি। বাকি সব অবৈধ দখলে আছে। ইতিপূর্বে জেলা প্রশাসক উচ্ছেদ অভিযান চালালেও পরে দখল হয়ে যায় না। তাছাড়া মাদক বিক্রি ও সেবনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে জানান।
তিনি বলেন, দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি করা যায় না, তবে আত্মরক্ষার জন্য আমরা এখানে শ্রমিকদের ঘর বানিয়ে দিই। মেডিক্যাল কলেজের সামনে ২০টি দোকান আছে। তবে দেবোত্তর সম্পতির উপর স্থাপনা সবই অবৈধ। কাগজে কলমে ৩২৩. ৮ একরের মধ্যে ১৩০ একর বাগানের দখলে আছে। নিজে জায়গা বিক্রি করলেও মৌখিকভাবে কাউকে বসান না বলে দাবি করেন তিনি। অথচ তার লিখিত কাগজেই বসতি গড়েছেন অনেকে।
এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে মন্দির ও চা বাগানের শ্রমিকদের নাম ভাঙ্গিয়ে তারাপুর চা বাগানের টিলা কেটে দোকান কোটা নির্মাণ করে ভাড়া দেন রিংকু চক্রবর্তী। স্থানীয় ৮নং ওয়ার্ডের সাবেক দাপুটে কাউন্সিলর জগদীশ দাসকে হাত করে নিজে লাভবান হন রিংকু। স্থানীয় করেরপাড়া ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় শিমুল ঘোষের কাছে জেএল-৭৬, খতিয়ান-১৭, দাগ নং-৯৭ দাগের ৫০ ফুট ও ২০ ফুটের দোকান কোটা বাবদ ৫ লাখ টাকা নেন ম্যানেজার রিংকু। এখানে সাক্ষী রাখেন স্থানীয় কাউন্সিলর জগদীশ দাসকে। ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট অঙ্গীকার নামায় স্বাক্ষর করে রিংকু।
এদিকে, গত বছর দোকান কোটা বন্ধে এবং অবৈধ সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা।
জানা গেছে, দেবোত্তর সম্পত্তি হওয়ার কারণে রাগীব আলীর হাত ছাড়া হয় তারাপুর চা বাগান। আদালত থেকে বাগানটির দায়িত্ব পান সেবায়েত পঙ্কজ দেবনাথ। তিনি বাগানটি চালাতে ব্যর্থ হন। এখন কমিটি পরিচালনা করছে বাগান। যে কারণে অর্থ সংকটে জানুয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে বাগানের সব কার্যক্রম। আর ঢিলেঢালা মালিকানার কারণে বাগান হয়েছে বিবর্ণ। এতোদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের চোখ বাগানের চারদিক দখলে। এবার ম্যানেজার নিজেই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
আর চা শ্রমিকদের কল্যাণ ও মন্দিরের নামে বাগানের জায়গা বিক্রি ও টিলা কেটে দোকানকোটা নির্মাণে সরাসরি জড়িত বাগান ব্যবস্থাপক রিংকু চক্রবর্তী।
চা বাগানে অবৈধভাবে ব্যবস্থাপক রিংকু কর্তৃক গাছ ও জায়গা বিক্রি এবং টিলা কাটার বিষয়ে জানাতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, আমার মিটিং কল করে এনিয়ে ব্যবস্থা নিব।