রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

শিশুদের সুরক্ষায় সিলেট জুড়ে টিকাদানের উৎসব, কতটুকু সুরক্ষিত আপনার শিশু?

সিলেট বিভাগের বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় শুরু হয়েছে বিনামূল্যের টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন। আজ ১২ অক্টোবর থেকে মাসব্যাপী এ টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৯ মাস থেকে ১৫  বছরের কম বয়সী শিশুরা এই ভ্যাকসিন গ্রহণের মাধ্যমে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সক্ষম।

কিন্তু টিকাদান কতটুকু সুরক্ষিত আপনার সন্তান ? এই প্রশ্ন জনমনে।

এ বিষয়ে অভিভাবকরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। কেউ কেউ টিকাদান কার্যক্রমকে ইতিবাচক ও সময়োপযোগী উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ এখনো টিকার নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতার অভাব অনুভব করছেন।

সিলেট সদর উপজেলার অভিভাবক রুবিনা আক্তার বলেন-সরকার বিনামূল্যে এই টিকা দিচ্ছে, এটা শিশুদের জন্য সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে আমরা অভিভাবকরা চাই টিকা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে—কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না, কতদিন সুরক্ষা দেবে, এসব বিষয় আগে জানলে আমাদের মানসিক স্বস্তি আরও বাড়বে।

আরেকজন অভিভাবক, নগরীর গোয়াইপাড়া এলাকার বাসিন্দা আল আমিন হোসেন বলেন-আমি আমার মেয়েকে টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়—টিকার পর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে না তো? আবার ভাবি, টাইফয়েডের মতো বিপজ্জনক রোগ থেকে এই টিকা আমার সন্তানকে কতটা সুরক্ষিত রাখবে। তাই টিকা সম্পর্কে আরও সচেতনতা ও তথ্য জানা দরকার বলে মনে করি।

টাইফয়েড জ্বর বাংলাদেশে একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিদ্যমান। দূষিত পানি ও খাবারের কারণে এ রোগ সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম থাকায় তারা টাইফয়েডে বেশি আক্রান্ত হয়। এজন্য শিশুদের টিকাদান কার্যক্রমকে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অত্যন্ত কার্যকর উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, পুরো মাস জুড়ে সিলেটের প্রতিটি উপজেলায় ধারাবাহিকভাবে টিকাদান কার্যক্রম চলবে। প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুকে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। তারা আশা করছে, এই কর্মসূচি শেষে সিলেট বিভাগের একটি বড় অংশ টাইফয়েড প্রতিরোধের আওতায় আসবে। একইসাথে অন্যান্য রোগ প্রতিরোধেও ভ্যাকসিন কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে কর্মকর্তারা মনে করছেন।

এ বিষয়ে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. মো. নাসির উদ্দিন বলেন-টাইফয়েড প্রতিরোধে টিকাদান কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে—সিলেট বিভাগের প্রতিটি শিশুকে এই ভ্যাকসিনের আওতায় আনা। স্বাস্থ্যকর্মীরা মাঠপর্যায়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন যাতে কোনো শিশুই বাদ না পড়ে। পাশাপাশি, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে আমরা অভিভাবকদেরও সচেতন করছি। শুধুমাত্র টিকাই নয়, সামগ্রিক পরিচ্ছন্নতা ও জনসচেতনতা নিশ্চিত হলেই টাইফয়েড প্রতিরোধ সম্ভব।

এই কর্মসূচিতে সহায়তা করছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।

এ বিষয়ে ইউনিসেফ সিলেট অঞ্চলের প্রধান দিল আফরোজা ইসলাম বলেন-আমাদের মূল লক্ষ্য হলো শিশুদের জন্য প্রতিরোধযোগ্য রোগ থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করা। টাইফয়েড টিকা শিশুদের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এটি তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একটি কার্যকর পদক্ষেপ। আমরা বিশ্বাস করি, এই উদ্যোগের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে টাইফয়েডের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। এছাড়াও, আমরা স্থানীয় কমিউনিটি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও কার্যকর করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ইউনিসেফের পক্ষ থেকে আমরা প্রতিটি শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ এবং এই উদ্যোগটি সিলেট অঞ্চলের সব অঞ্চলে আরও বিস্তৃত করা

বিভাগীয় তথ্য অফিসের পরিচালক মীর মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন বলেন—এই টিকার মূল লক্ষ্য হলো শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে তাদের সম্পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এটি শতভাগ নিরাপদ ও কার্যকর একটি টিকা, যা ইতোমধ্যে হালাল সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত। তাই এ নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রতিটি শিশুকে টিকার আওতায় আনতে হবে, কারণ আজকের সুরক্ষিত শিশু মানেই আগামী দিনের সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি।

এদিকে স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরাও মনে করছেন, এই উদ্যোগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত রাখবে।স্বাস্থ্যকর্মী

লিপি দাস জানান-ভ্যাকসিন নেওয়ার মাধ্যমে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এটি শুধু তাদের জীবনই রক্ষা করে না, পুরো সমাজকেও রোগের ঝুঁকি থেকে বাঁচায়।

টিকাদান কর্মসূচির পাশাপাশি স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সচেতন করার জন্য বিশেষ সেশন আয়োজন করা হচ্ছে। এসব সেশনে টিকাদানের কার্যকারিতা, সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে।

এ বিষয়ে খাসদবীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদ নেওয়াজ বলেন-বাংলাদেশে টাইফয়েড জ্বরের প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হল ভ্যাকসিনেশন। সরকার এই ভ্যাকসিনটি প্রতিটি শিশুর জন্য সহজলভ্য এবং বিনামূল্যে প্রদান করে, তবে তা আগামী প্রজন্মকে এই মারাত্মক রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখবে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে এমন উদ্যোগ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ এক সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।

সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন—টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে যারা মৃত্যুবরণ করে, তাদের বেশিরভাগই ৯ থেকে ১৫ বছরের নিচের শিশু। তাই এই বয়সী সব শিশুকে সুরক্ষিত রাখতে সারাদেশে টিকাদান কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য—একটি শিশুও যেন টাইফয়েডের ঝুঁকিতে না থাকে। আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করবো, কোনো গুজব বা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে আপনার সন্তানকে অবশ্যই টিকা দিন। এই টিকাই পারে তাদের জীবনকে নিরাপদ রাখতে।

এ বিষয়ে সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন—টাইফয়েড প্রতিরোধে এই টিকাটি শতভাগ নিরাপদ ও কার্যকর। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুমোদিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত একটি ভ্যাকসিন। টিকা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং প্রতিটি শিশুর জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সুরক্ষা। আমরা চাই, অভিভাবকরা যেন ভয়ের পরিবর্তে আস্থা রাখেন এবং সময়মতো সন্তানদের টিকা দেন। কারণ, প্রতিরোধই সবচেয়ে বড় চিকিৎসা। এই টিকার মাধ্যমে টাইফয়েড সংক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব, যা সামগ্রিকভাবে শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় বড় ভূমিকা রাখবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিলেট বিভাগীও সমন্বয়কারী ডাঃ সুফী মুহাম্মাদ খালিদ বলেন- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের এক্সপার্টসের মাধ্যমে, টিকাদানকারীদের প্রশিক্ষণ, টিকা পরবর্তী বিরূপ ঘটনার বিষয়ে ডাক্তারবৃন্দদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন| তাছাড়াও উনারা প্রতিনিয়ত এই টিকার কোল্ড চেইন মনিটরিং,সুপারভিশন করে সরকারকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও সিটি কর্পোরেশনে | এই টিকাদান ক্যাম্পেইন উপলক্ষ্যে সংস্থাটির আন্তর্জাতিক মিনিটরিংবৃন্দ প্রতিটি বিভাগে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিবেন | ডাঃ খালিদ আরো বলেন, এই টিকাদান ক্যাম্পেইনে উদ্দীষ্ট সকল শিশুদেরকে টিকা দিয়ে টাইফইড রোগের কারনে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনবো |

এ বিষয়ে সিলেট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন—টাইফয়েড প্রতিরোধে টিকাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু শিশুদের নয়, পুরো কমিউনিটিকে সুরক্ষা দেয়। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্রতিটি শিশুকে এই সুরক্ষার আওতায় আনা।

তিনি আরও জানান, প্রতিটি ইউনিয়নে টিকাদান কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে অভিভাবকদের সচেতন করছেন যাতে কোনো শিশুই বাদ না পড়ে।


ডা. আনিসুর রহমান বলেন, টাইফয়েড একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ, তাই সবাইকে টিকা সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। অভিভাবকদের সহযোগিতা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয় থাকলে আমরা সিলেট বিভাগকে টাইফয়েডমুক্ত অঞ্চলে পরিণত করতে পারব।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন—এ পর্যন্ত যেসব টিকা দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে টাইফয়েড প্রতিরোধে এই টিকাটি সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর। গবেষণা অনুযায়ী, এই ভ্যাকসিন গ্রহণের পর প্রায় ৮৫ শতাংশ শিশু টাইফয়েড থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকে। বাকি ১৫ শতাংশের মধ্যে যদি কেউ আক্রান্তও হয়, তবে রোগের তীব্রতা অনেক কম থাকে এবং জটিলতা দেখা দেয় না। তাই অভিভাবকদের অনুরোধ করছি, তারা যেন কোনো ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই সন্তানদের এই টিকা গ্রহণে উৎসাহিত করেন।

এই সম্পর্কিত আরো