ওসমানী হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পান্জা লড়ছেন ৪৪ বছরের আব্দুর রহমান, পাশে বসে কাঁদছেন তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে কাছে গিয়ে জানা গেলো আব্দুর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন তার বর্তমান অবস্থা খুবই খারাপ, যে কোন উপায়ে তাকে আইসিইউ তে নিতে হবে কিন্তু কোন আইসিইউ খালি নেই তাদের আর্থিক অবস্থায়ও খুব খারাপ। ঘন্টা খানিক পরে আব্দুর রহমান মারা যান। শুধু আব্দুর রহমান নয় আইসিইউ এর অভাবে প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যান।
সিলেটের সরকারি হাসপাতালগুলোতে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা যেনো সোনার হরিণ। রোগীর সংখ্যা বাড়লেও পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই। ফলে সংকটাপন্ন রোগীদের বড় অংশকেই বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়। সেখানে ব্যয়বহুল চিকিৎসার কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুরো অঞ্চলের প্রধান সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র। কিন্তু এখানকার আইসিইউ শয্যা হাতেগোনা, প্রায় সবসময়ই পূর্ণ থাকে। সীমিত শয্যার কারণে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হয়।ফলে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটে বেড়াতে হয় রোগীর স্বজনদের।
হবিগন্জের বাহুবল থেকে আসা এক রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন - ডাক্তার বলেছেন রোগীকে বাঁচাতে আইসিইউ দরকার। কিন্তু হাসপাতালে জায়গা নেই। বেসরকারি হাসপাতালে নিতে বলছেন, সেখানে দিনে লাখ টাকার বেশি খরচ। আমরা কিভাবে সামলাব?
আরেক ভুক্তভোগী,নগরীর গোয়াইপাড়া এলাকার ফাতেমা বেগম শিউলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন-শুধু আইসিইউ বেড না পাওয়ার কারণে গত এক মাসেই আমাদের দুই আপনজনকে হারাতে হয়েছে। কী বলবো—ভাগ্যে না থাকলে আর কী করার আছে! তবে গরিব মানুষের জন্য জীবনটা সবসময়ই যেন আরও কঠিন, চিকিৎসা তো এখন বিলাসিতা। হাসপাতালের করিডরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও যখন বেড মেলে না, তখন বুক ভেঙে যায়। অথচ টাকার অভাবে বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার সুযোগও আমাদের নেই।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পুরো সিলেট বিভাগে সরকারি আইসিইউ শয্যার সংখ্যা অত্যন্ত কম। প্রতিটি জেলা হাসপাতালেই গড়ে মাত্র ১০–২০ শয্যা। জনসংখ্যার তুলনায় এটি মারাত্মক অপ্রতুল। প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য প্রায় ৫–৬টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। আইসিইউ না পেয়ে আক্রান্ত রোগীরা প্রায়শই সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে অবনতি ঘটে। মারা যায় শত শত মানুষ।
এ বিষয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ কনসালটেন্ট ডা. জাহিদ হোসাইন বলেন-আমাদের হাসপাতালে তিনটি বিল্ডিং মিলে বর্তমানে মাত্র ৩০টি আইসিইউ শয্যা আছে, যা কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়। স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ১ হাজার শয্যার হাসপাতালে অন্তত ১০ শতাংশ, অর্থাৎ কমপক্ষে ১০০টি ক্রিটিকাল কেয়ার বেড (আইসিইউ, এইচডিইউ ও সিসিইউ) থাকা উচিত। অথচ এখানে সেই সংখ্যার কাছাকাছিও নেই। এর ওপর ১ হাজার শয্যার পরিবর্তে প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ রোগী ভর্তি থাকেন । ফলে চাহিদার তুলনায় আইসিইউ বেড একেবারেই অপ্রতুল হয়ে যায়। এতে গুরুতর রোগীরা সময়মতো ক্রিটিকাল কেয়ার না পেয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়েন। শুধু আইসিইউ নয়, হাসপাতালের প্রায় সব বিভাগেই জনবল ও আধুনিক সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে, যা মানসম্মত চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে সিলেট শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন-আমাদের হাসপাতালে বর্তমানে মোট ১৬টি আইসিইউ বেড রয়েছে। এর মধ্যে ডায়ালাইসিস সুবিধাসহ দুটি বেড রাখা হয়েছে। তবে জনবল সংকট ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির ঘাটতির কারণে সবগুলো বেড সবসময় পূর্ণমাত্রায় সচল রাখা সম্ভব হয় না। আইসিইউ কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য আলাদা পূর্ণাঙ্গ সেটআপ ও বিশেষায়িত টিম অত্যন্ত জরুরি, যা এখনো এখানে গড়ে তোলা যায়নি। নতুন জনবল নিয়োগ এবং আধুনিক সরঞ্জাম সংযোজন হলে আমরা এ সেবাকে আরও বিস্তৃত করতে পারব বলে আশা করি।
এ বিষয়ে সিলেট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন-সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সংকট এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য রোগী আইসিইউ-সেবা পাওয়ার আশায় হাসপাতালে আসেন, কিন্তু আসনসংখ্যা সীমিত থাকায় অনেককেই হতাশ হয়ে ফিরতে হয়।জায়গার সীমাবদ্ধতা, পর্যাপ্ত জনবল না থাকা এবং অবকাঠামোগত ঘাটতির কারণে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারপরও ধাপে ধাপে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। নতুন বাজেট ও প্রকল্প অনুমোদন পেলে আইসিইউ শয্যা বৃদ্ধি, আধুনিক সরঞ্জাম সংযোজন এবং জনবল নিয়োগের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ সংকট অনেকটাই নিরসন হবে বলে আমি আশা করছি।
এ বিষয়ে সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত বলেন -আইসিইউ সংকট আমাদের দীর্ঘদিনের বাস্তবতা। রোগীর তুলনায় সরকারি হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা একেবারেই অপ্রতুল, যার কারণে প্রতিদিনই অনেক সংকটাপন্ন রোগীকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়। এর পেছনে জায়গার অভাব, আধুনিক সরঞ্জামের ঘাটতি এবং বিশেষায়িত জনবল সংকট বড় কারণ।
তবে করোনাকালে শামসুদ্দিন হাসপাতালসহ কয়েকটি উপজেলায় আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছিল, যা আংশিকভাবে সহায়তা করেছে। বাজেট অনুমোদন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও জনবল নিয়োগ সম্পন্ন হলে আইসিইউ শয্যা বাড়বে, আধুনিক সরঞ্জাম যুক্ত হবে এবং সেবা আরও বিস্তৃত হবে। আমরা আশাবাদী, এ উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে সিলেটের রোগীরা আর এভাবে অবহেলিত হবেন না।
এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম বলেন—সরকারি হাসপাতালে জায়গার সংকটটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মূলত এটি একটি ৫ শ শয্যার হাসপাতালকে ৯ শ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে রোগী থাকে আড়াই থেকে তিন হাজার । ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি বিভাগে তীব্র ভীড় ও সেবার ঘাটতি তৈরি হয়।
এ পরিস্থিতি সামাল দিতে আমরা জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। ওসমানী হাসপাতালের পাশে যে ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মিত হচ্ছে, সেখানে কয়েকটি ফ্লোরে কার্ডিওলজি ও শিশু ইউনিট সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। এতে আইসিইউ ও অন্যান্য ক্রিটিকাল কেয়ারের জন্য অতিরিক্ত জায়গা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি শামসুদ্দিন হাসপাতালের পাশে নতুন নির্মিত হাসপাতালটি দ্রুত চালু করার চেষ্টা চলছে। আশা করি আগামী এক–দুই মাসের মধ্যেই এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে চাপ অনেকটাই কমবে এবং রোগীরা উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ পাবেন।