বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের সংকট ও দূষণের তালিকায় এখন শীর্ষে প্লাস্টিক দূষণ। শুধু সমুদ্র নয়, বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলেও এর ভয়াবহ প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর সবচেয়ে উদ্বেগজনক উদাহরণ সুনামগঞ্জের রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওর।
সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের আনাগোনায় টাঙ্গুয়ার হাওরে জমছে টনকে টন প্লাস্টিক বর্জ্য। একদিকে নৌকাভ্রমণ, অন্যদিকে খাওয়ার পর পরিত্যক্ত বোতল, চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, প্লেট-গ্লাসÑ সব মিলিয়ে হাওরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে অপচনশীল প্লাস্টিক।
স্থানীয়রা জানান, টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক যেভাবে প্রতিবছর বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পর্যটকসৃষ্ট দূষণও। নৌকা থেকে পানির বোতল, চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট, পলিথিনসহ প্লাস্টিক বর্জ্য ছুড়ে হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছেন পর্যটকেরাই।
সম্প্রতি পর্যটন নৌকায় করে টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়ে দেখা গেছে, হাওরের পানিতে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলার বিষয়ে পর্যটক ও নৌকার কর্মীরা খুব একটা সচেতন নন। অল্প কিছু নৌকা ছাড়া বাকিগুলোতে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কোনো ডাস্টবিনেরও দেখা মেলেনি। ঘাটে থাকা নৌকাগুলোর আশপাশেই পানিতে ভাসছিল পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, পানির খালি বোতল।
মধ্যনগরের বংশীকুণ্ডা গ্রামের ট্রলার মালিক জয়কুল মিয়া জানান, পর্যটকরা সবকিছুতেই প্লাস্টিক ব্যবহার করেন এবং আমাদের নিষেধ সত্ত্বেও তা পানিতে ফেলে দেন। কিন্তু অনেকেই এ বিষয়ে গুরুত্ব দেন না। বিশেষ করে তরুণেরা এসব মানতে চান না। পর্যটকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বাড়ানোর সুযোগও তাদের থাকে না।
এ নিয়ে হাওরপাড়ের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘জনাশিউস’র সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা যায়, একটি ১৫ জনের দল ভ্রমণ শেষে অন্তত এক কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য হাওরে ফেলে আসেন। সে হিসেবে ভরা মৌসুমে দিনে অন্তত এক টন প্লাস্টিক বর্জ্য মিশছে হাওরের পানিতে।
জনাশিউস সভাপতি সাজেদা আহমেদ বলেন, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরকে বাঁচাতে হলে, পর্যটকদের সচেতন করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে এই দূষণ রোধ করা প্রয়োজন।’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ডাহুক-এর পরিচালক মো. মাগফি রেজা সিদ্দিক জানান, ‘টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক পরিবহনকারী নৌকা ও তাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক সামগ্রীর কারণে হাওরের তলদেশে এখন কয়েক কোটি টাকার প্লাস্টিক বর্জ্য জমা হয়েছে।’
হাওর শুকিয়ে গেলে এসব প্লাস্টিক বর্জ্য জমিতে পড়ে থাকে। সেগুলো আলাদাভাবে পরিষ্কার করতে হয় কৃষকদের। মধ্যনগরের নিশ্চিন্তপুর গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম বলেন, ‘পানি গেলেগা আগে আমরা সুন্দর করে ফসল চাষ করতে পারতাম। এখন দেহা যায়, জমিতে অনেক বোতলুআবর্জনা জমা হয়ে থাকে। এতে ফসলের ক্ষতি হইতাছে।’
হাওরে পর্যটকদের ফেলা বর্জ্যে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘পর্যটকদের ফেলা অপচনশীল বর্জ্য জমিতে মিশছে। এতে পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, তেমনি পানি শুকালে কৃষকদেরও সমস্যা হচ্ছে। পর্যটকেরা সচেতন হয়ে রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে বা নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেললে পরিবেশ ও হাওরের এই ক্ষতিটা হতো না।’