মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

নতুন নামে পুরোনো নে*শা: ‘ইসকফ’র ছোবলে ধ্বং-স যুবসমাজ

ফেনসিডিলের বিকল্প হিসেবে দেশে ব্যবহার হচ্ছে নতুন মাদক ‘ইসকফ’ সিরাপ। ভারত থেকে বাংলাদেশে আবারও এবার নতুন মোড়কে মাদকের অনুপ্রবেশ বেড়েছে ব্যাপক হারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়িয়ে দেশে ঢুকছে ‘ইসকফ’ নামের একটি নতুন মাদক, যা মূলত কাশির সিরাপ হিসেবে পরিচিত। অথচ বাস্তবে এটি ফেনসিডিলের মতোই ক্ষতিকর এবং আসক্তি সৃষ্টিকারী। আর এই মাদকের প্রধান রুট হচ্ছে সিলেটের হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও মৌলভীবাজার । আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করে এই রুটগুলো থেকে বিপুল পরিমান ‘ইসকফ’ সিরাপ জব্দ করেছে এবং এসময় বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (৪ মাসে) অন্তত অর্ধশতাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৯), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং পুলিশ এই অভিযান পরিচালনা করেছে। এই অভিযানগুলোতে ভারতীয় অবৈধ মাদক ‘ইসকফ’ সিরাপসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে তারা। গত ৪ মাসের অভিযানে প্রায় ২ হাজার ৫শ’ ৬১ বোতল ‘ইসকফ’ সিরাপসহ ১ জন নারীসহ মোট ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সর্বশেষ সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) আনুমানিক রাত পৌণে ৫টার দিকে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানাধীন নোয়াপাড়া রেস্টুরেন্টের সামনে অভিযান চালিয়ে ১শ’ ৫০ বোতল ইসকফ সিরাপসহ মোঃ সৈকত (১৮) গ্রেফতার করা হয়। তিনি পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার মদনপুরা এলাকার শফিকুল ইসলামের ছেলে।
 
এর আগে শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) আনুমানিক সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হবিগঞ্জ জেলার সদর থানাধীন ১০নং লস্করপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের লস্করপুর রেলক্রসিং থেকে ৯৯ বোতল ফেনসিডিলসহ ১ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৯)। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি ময়মনসিংহ জেলার কোতোয়ালী থানার চর গোবিন্দপুর এলাকার মোঃ আঃ হাকিমের ছেলে মো. রাসেল মিয়া (২৭)।

একই দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থেকে ১৫০ কেজি গাঁজা ও ১ হাজার ৯৫ বোতল ইসকফ সিরাপসহ মোঃ মোস্তফা মিয়া মোস্ত (৪০) নামের পেশাদার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৯)। এসময় তার সাথে থাকা আরও ৫জন ব্যক্তি কৌশলে পালিয়ে যান বলে জানায় র‌্যাব-৯। সে ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর থানার সিংগারলি ইউপির কাশিরনগর এলাকার মৃত আঃ কাদের মিয়া ছেলে।

মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর থানাধীন সিংগারবিল এলাকা থেকে ১শ’ ৮৫ বোতল ‘ইসকফ’ সিরাপসহ মো. বাহার মিয়া (৬২)-কে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৯)। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর থানার চাওড়া এলাকার (মিয়া চাঁন মেম্বার বাড়ী) মৃত চাঁন মিয়া মেম্বারের ছেলে।
 
সোমবার (১০ আগস্ট) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থানাধীন শরীফপুর এলাকা থেকে থেকে ৪৬ বোতল ‘ইসকফ’ সিরাপসহ ১ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৯)।  গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার বেরিরগাঁও এলাকার আজম আলীর ছেলে আবুল হোসেন বাবুল (২৮)।

রবিবার (২০ জুলাই) রাত আনুমানিক ২টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর এলাকা থেকে ১৬০ বোতল ‘ইসকফ’ সিরাপসহ ১ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৯)। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর থানাধীন নোয়াবাদী এলাকার আশিক চৌধুরীর ছেলে মো. জুনায়েদ চেীধুরী (২০)।

শুক্রবার (২৭ জুন) সাড়ে ১২টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর থানাধীন সিংগারবিল ইউপির কাশিনগর এলাকায় মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে ১শ’ ৯৮ বোতল ‘ইসকফ’ সিরাপসহ মোঃ জুম্মন মিয়া (২০)-কে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৯)।  সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর থানার সিংগারবিল ইউনিয়নের কাশিনগর পূর্বপাড়া (নুরুর বাড়ি)-র মৃত ইদ্রিস মিয়ার ছেলে।
 
শুক্রবার ( ১৩ জুন) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর থানার সিঙ্গারবিল কাশিনগর এলাকায় র‌্যাব-৯ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ১শ’ ৯৬ বোতল ইসকফ সিরাপসহ মো. মহসিন ওরফে পেপে (৩১)-কে গ্রেফতার করে। তিনি কাশিনগর গ্রামের মো. রমজান মিয়ার ছেলে।

(১০ জুন) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর থানার নলগড়িয়া এলাকায় মাদক বিরোধী অভিযান চালিয়ে র‌্যাবের জালে ধরা পড়েছেন নিলুফা বেগম (৩৩)। ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর থানার নলগড়িয়া গ্রামের মো. রমজান খাঁ ওরফে রাজুর স্ত্রী। এসময় তার হেফাজত থেকে ১শ’ ৫৭ বোতল নেশাজাতীয় ইসকফ সিরাপ জব্দ করা হয়।

সোমবার (২ জুন) রাত ৯টার দিকে উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের পিরের বাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মাদক জব্দ করে। বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে চোরাকারবারিরা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে ২শ’ ৮৫ বোতল ভারতীয় নিষিদ্ধ সিরাপ ‘পিবিআরএক্স’ জব্দ করা হয়।
 
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘ইসকফ’ ও ‘ফেনসিডিল’ উভয়েই কোডিন ফসফেট নামক একটি নেশাদ্রব্য উপাদান দিয়ে তৈরি। শুধুমাত্র ভিন্ন নামে বাজারজাত হওয়ায় এটি বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুরোনো ফেনসিডিল কারবারিরা এখন নতুন করে এই মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘ইসকফ’ উৎপাদন করে ভারতের ল্যাবোরেট ফার্মাসিউটিক্যাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যদিও এটি কাশির সিরাপ হিসেবে নিবন্ধিত, তবে মাদক হিসেবে অপব্যবহারের হার বাড়তে থাকায় ভারত সরকার ইতিমধ্যে সিরাপটি নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও এর উৎপাদন বন্ধ হয়নি। বরং ভারতেই এটি অবৈধভাবে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন রাজ্যে, এবং চোরাইপথে পাচার হয়ে আসছে বাংলাদেশে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ‘এই পরিস্থিতিতে কেবল আইনগত ব্যবস্থার পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানোও জরুরি। অনেকে এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না যে ‘ইসকফ’ও ফেনসিডিলের মতোই ক্ষতিকর, কেবল নামটাই আলাদা। কাশির ওষুধ হিসেবে চিহ্নিত হলেও, এর মূল ব্যবহার এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদক হিসেবে। এই সিরাপ শুধু শরীর নয়, ধ্বংস করছে সমাজ ও পরিবারও।’
 
র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৯) এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া অফিসার) কে এম শহিদুল ইসলাম সোহাগ বলেন,‘মাদক কারবারিরা নিয়মিত কৌশল পরিবর্তন করছে। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স জারি করা আছে। আমরা নিয়মিত মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছি। এক সময় ফেনসিডিল ছিল বড় সমস্যা, এখন তারা একই উপাদান দিয়ে তৈরি নতুন নামে মাদক এনে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। ইসকফের মতো কাশির সিরাপকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করে যুবসমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা।’ তিনি আরও বলেন, ‘র‍্যাব শুরু থেকেই মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, অবৈধ অস্ত্রসহ সবধরনের অপরাধ দমনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। ভবিষ্যতেও এই ধরনের অবৈধ মাদক প্রবেশ ও বিস্তার রোধে র‍্যাবের প্রতিটি সদস্য অঙ্গীকারবদ্ধভাবে কাজ করবে।’

এই সম্পর্কিত আরো