আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে নির্বাচনী ডামাডোল বেজে উঠেছে। চিরসবুজ চা-বাগান, পাহাড়ি অঞ্চল আর হাওরবেষ্টিত এই গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন ঘিরে ভোটারদের মধ্যে তীব্র কৌতূহল দেখা দিয়েছে। কুশিয়ারা, বিজনা, খোয়াইসহ বিভিন্ন নদীবাহিত এবং বিবিয়ানা ও রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের মতো শিল্পাঞ্চল সমৃদ্ধ এই আসন বরাবরই রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
হবিগঞ্জ জেলার মধ্যে নবীগঞ্জ উপজেলা লন্ডনে বসবাসরত প্রবাসীদের একটি বড় অংশ নিয়ে গঠিত। প্রতিটি নির্বাচনেই এখানকার প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা স্থানীয় থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত প্রভাব ফেলে। ইতিপূর্বে দুইজন লন্ডন প্রবাসী হবিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, যার মধ্যে বিএনপির শেখ সুজাত মিয়া এবং জাতীয় পার্টির এম.এ. মুনিম চৌধুরী বাবু উল্লেখযোগ্য। এবারও বেশ কয়েকজন লন্ডন প্রবাসী প্রার্থীরূপে আলোচনায় আছেন, যা এই আসনের রাজনৈতিক সমীকরণকে আরও জটিল করে তুলছে।
বিএনপি: এই আসনে বিএনপির সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকা দীর্ঘ। সাবেক এমপি শেখ সুজাত মিয়া, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. খালেদ মহসিন (যিনি যুবাইবা রহমানের খালু), যুক্তরাজ্য যুবদলের সাবেক নেতা তালহা চৌধুরী, সাবেক মেয়র ছাবির আহমদ চৌধুরী, শিকাগো বিএনপির সভাপতি শাহ মোজাম্মেল নান্টু, বিএনপি নেতা শেখ মহিউদ্দিন, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা মুখলিছুর রহমান, যুক্তরাজ্য যুবদলের সাবেক সভাপতি দেওয়ান মুকাদ্দিম চৌধুরী নিয়াজ এবং নবীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সৈয়দ মতিউর রহমান পেয়ারা মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন। এছাড়া, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার পুত্র ড. রেজা কিবরিয়া ২০১৮ সালের মতো এবারও বিএনপির টিকেটে নির্বাচন করতে পারেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। যদিও তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাঠে সক্রিয় নন, তবে বিএনপির একটি শক্তিশালী অংশ তাকে প্রার্থী করার জন্য তোড়জোড় চালাচ্ছে।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল এই আসনে একটি বড় সমস্যা। সাবেক এমপি শেখ সুজাত মিয়া এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান শেফুর নেতৃত্বে নবীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি দুটি ভাগে বিভক্ত। এই কোন্দলের কারণে আটবার কাউন্সিল পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা শেফু গ্রুপের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এই বিভাজন দলের নির্বাচনী প্রস্তুতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
জামায়াতে ইসলামী: জামায়াতে ইসলামী (দাড়ি পাল্লা) এই আসনে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, কারণ তারা ইতিমধ্যেই সিলেট মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মোঃ শাহজাহান আলীকে একক প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছে। তিনি ইতিমধ্যেই গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক ও গণসংযোগ শুরু করেছেন। শাহজাহান আলী বলেন, "হবিগঞ্জ-১ আসনের মানুষ নতুন কিছু চায়। জামায়াতে ইসলামী ছাড়া সব দলের এমপি এখানে ছিলেন, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেননি। তাই নবীগঞ্জ ও বাহুবলের মানুষ এবার নতুন করে জামায়াতকে ক্ষমতায় দেখতে চায়।"
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি): জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এনসিপিও এই আসনে তাদের প্রচারণা চালাচ্ছে। দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও জেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী পলাশ মাহমুদ, সদস্য অ্যাডভোকেট ফখরুদ্দিন আহমেদ জাকি, আরিফ তালুকদার এবং তুষার পাঠান আলোচনায় এসেছেন। এনসিপির জেলা কমিটির যুগ্ম সমন্বয়কারী মাহবুবুল বারী চৌধুরী জানান, নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষে তারা যোগ্যতার ভিত্তিতে একক প্রার্থী বাছাই করবেন।
খেলাফত মজলিস (দেয়াল ঘড়ি): জেলা খেলাফত মজলিসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম জাকী একক প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (খেজুর গাছ): জেলা জমিয়তের সেক্রেটারি মুফতি সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরীকে একক প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়েছে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ: মুফতি মাওলানা তাজুল ইসলামকে তাদের প্রার্থী মনোনীত করেছে।
গণঅধিকার পরিষদ: কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন জীবন সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন।
তরুণ ও গতিশীল প্রার্থীরা:
এ আসনের তরুণ ও গতিশীল প্রার্থীদের মধ্যে তালহা চৌধুরী বিশেষভাবে আলোচিত। তারেক রহমান ঘোষিত রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা বাস্তবায়নে তিনি নবীগঞ্জ-বাহুবলের প্রতিটি ইউনিয়নে নেতাকর্মীদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। করোনা মহামারি ও বন্যার সময় ত্রাণ বিতরণসহ মানবিক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে তিনি তৃণমূলের আস্থা অর্জন করেছেন। তার আধুনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মীবান্ধব মনোভাব যুবসমাজের মধ্যে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রফেরত বিএনপি নেতা শাহ্ মোজাম্মেল নান্টু ব্যানার, ফেস্টুন ও জনসংযোগের মাধ্যমে ইতোমধ্যে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন। সাবেক ছাত্রনেতা মুখলিছুর রহমানও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেয়াল লিখন ও ব্যানার-পোস্টারের মাধ্যমে প্রচারণায় সক্রিয় রয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, হবিগঞ্জ-১ আসনে মোট ভোটার ৪,৩১,৪২২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২,১৭,৮৭৬ জন, নারী ২,১৩,৫৪৪ জন এবং ২ জন হিজড়া ভোটার রয়েছেন।
এ আসনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ (১৯৯১): জাতীয় পার্টির খলিলুর রহমান চৌধুরী রফি (লাঙ্গল) বিজয়ী হয়, ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬): বিএনপি'র শেখ সুজাত মিয়া বিজয়ী (বিরোধী দল বর্জন), সপ্তম জাতীয় সংসদ (জুন ১৯৯৬): আওয়ামী লীগের দেওয়ান ফরিদ গাজী (নৌকা) বিজয়ী, অষ্টম জাতীয় সংসদ (২০০১): আওয়ামী লীগের দেওয়ান ফরিদ গাজী (নৌকা) বিজয়ী. নবম জাতীয় সংসদ (২০০৮): আওয়ামী লীগের দেওয়ান ফরিদ গাজী (নৌকা) বিজয়ী, উপ-নির্বাচন (২০১১): বিএনপি প্রার্থী শেখ সুজাত মিয়া (ধানের শীষ) বিজয়ী, দশম জাতীয় সংসদ (২০১৪): জাতীয় পার্টির এম.এ. মুনিম চৌধুরী বাবু (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) বিজয়ী, একাদশ জাতীয় সংসদ (২০১৮): আওয়ামী লীগের গাজী মোঃ শাহনেওয়াজ (নৌকা) বিজয়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ (২০২৪): স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাড. আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়া (ঈগল) বিজয়ী। (বিএনপি-জামায়াতসহ প্রধান বিরোধী দলগুলো বর্জন করে)।
হবিগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির তৃণমূলের অনিশ্চয়তা, জামায়াতের সংগঠিত প্রস্তুতি এবং এনসিপির আন্দোলনের স্পিরিট – এই তিন মেরুতে ভোটের সমীকরণ দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় নির্বাচনী বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি'তে প্রার্থীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তবে ভোটের মাঠে 'হেভিওয়েট' হিসেবে ড. রেজা কিবরিয়া, ডা. খালেদ মহসিন, শেখ সুজাত মিয়া ও ছাবির আহমদ চৌধুরী এগিয়ে রয়েছেন। ২০২৪ সালের ৫ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ বর্তমানে রাজনৈতিক ময়দানে কার্যত অনুপস্থিত। এদিকে বিএনপি মাঠ গোছাতে একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থীকে সামনে নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কে মনোনয়ন পাবেন, আর কে জিতবেন- তা নির্ভর করবে দলীয় কৌশল ও মাঠের লড়াইয়ের ওপর।