সিলেটের তিনটি মেঘা প্রকল্পের কাজে স্থবিরতা দেখা দেখা দিয়েছে। এতে দুর্ভোগ বাড়ছে এই অঞ্চলের মানুষের। এই প্রকল্পগুলোর কাজ কবে শেষ হবে এ ব্যাপারেও নিশ্চিত নয় কেউ।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সিলেটের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে নেওয়া হয়েছিলো তিনটি মেঘা প্রকল্প। বিগত সরকারের আমলেই নানা জটিলতায় প্রকল্প তিনটির কাজে স্থবিরতা দেখা দেয়। নতুন সরকারের আমলেও এসব প্রকল্পের কাজে আশানুরুপ গতি পায়নি। এসব মেগা প্রকল্পগুলোতে দেখা দেয় ‘মেগা জট’।
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ
চার বছরে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কাজ হয়েছে মাত্র ২২ ভাগ। নকশার ত্রুটির অজুহাতে প্রায় দুইবছরের অধিক সময় ধরে বন্ধ রয়েছে প্রকল্পের কাজ। সিলেট-ঢাকা মহাসড়ককে ৬ লেনে উন্নীতকরণের আশ্বাস শুনতে শুনতে বিরক্ত সিলেটবাসী। মহাসড়কটির উন্নয়ন কাজ হয়েছে মাত্র ১৬ ভাগ। আর সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক চারলেনে উন্নিতকরণের কাজ এখনও দৃশ্যমানই হয়নি। ফলে মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে রীতিমতো আশাহত সিলেটের মানুষ।
২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ মেগা প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। প্রায় ২২০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের আওতায় দ্বিতল বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ভবন, ৬টি বোর্ডিং ব্রিজ, কনভেয়ার বেল্টসহ ৩৬টি চেক ইন কাউন্টার, ২৪টি পাসপোর্ট কন্ট্রোল কাউন্টার, ৬টি এস্কেলেটর, ৯টি লিফট, ৩টি লাগেজ কনভেয়ার বেল্ট, কার্গো ভবন, জেট ফুয়েল ডিপো ও কন্ট্রোল টাওয়ারসহ আনুষাঙ্গিক আরও কিছু অবকাঠামো নির্মাণের কথা ছিল। ২০২০ সালের ১ অক্টোবর উদ্বোধন হওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু ২২ শতাংশ কাজ হওয়ার পর নকশায় ত্রুটির কথা বলে বন্ধ রাখা হয় প্রকল্পের কাজ। প্রায় এক পঞ্চমাংশ কাজ শেষ হওয়ার পর নকশায় ত্রুটি ধরা পড়ার বিষয়টিকে রহস্যজনক বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
অনেকের দাবি, সময়ক্ষেপণ করে প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়ানোর পাঁয়তারা ও সঠিক তদরকির অভাবেই ওসমানী বিমানবন্দরের মেগা প্রকল্পটি আটকে রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিমানবন্দরের পুরো টার্মিনাল ভবনটিই ভুল নকশায় তৈরি করা হয়েছে। কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানো সেই ভুল নকশায় কাজ হলে ওসমানী বিমানবন্দরের সক্ষমতা কমবে। এই নকশায় আন্তর্জাতিক রুটে উড়োজাহাজ চলতে গেলে ভেঙে ফেলতে হবে টার্মিনাল ভবন। এছাড়া পুরনো নকশায় থাকা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলাচল উপযোগী ছোট আকারের উড়োজাহাজের জন্য নির্মিতব্য বোর্ডিং ব্রিজের নকশা পরিবর্তন করে আন্তর্জাতিক রুটের উপযোগী করতে হবে।
ভুল নকশায় কাজ আটকে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেলস এজেন্ট অব বাংলাদেশ (আটাব) সিলেটের সাবেক সভাপতি আবদুল জব্বার জলিল বলেন, ‘কাজ শুরু করার আগেই নকশা যাছাই করা দরকার ছিলো। তাহলে এই সমস্যা হতো না। এখন মাঝপথে ধরা পড়ায় অনেক লোকসান গুণতে হবে। সিলেটের প্রবাসীদেরও ভোগান্তি বাড়বে।
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শাহ জুলফিকার হায়দার বলেন, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের নকশায় কিছু সমস্যা ছিল। নকশা তৈরি করা কোরিয়ান কোম্পানিই এই ভুল করেছে। এ কারণে ওসমানী বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজ আটকে আছে।
সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক ৬ লেন
সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নীতকরণে প্রায় ১৭ হাজার টাকার প্রকল্প পাশ হয়। প্রকল্পের নকশা প্রণয়নের পর ২০২০ সালে এসে ত্রুটি ধরা পড়ে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো। তবে এই প্রকল্পের কাজই শুরু হয় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
এরপর দুই বছরের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কাজ এগিয়েছে মাত্র ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ। জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় কাজ হচ্ছে ধীরগতিতে। বর্তমান সড়কের দু’পাশে ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণের কাজ চলছে। প্রকল্পের কাজে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় যাতায়াত ভোগান্তিতে সিলেটে অঞ্চলের কোটি মানুষ।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মহাসড়কটি ৬ লেনে উন্নিতকরণের কাজ কোনভাবেই সম্ভব হবে না। সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়েও তৈরি হবে জটিলতা।
ঢাকা সিলেট ৬ লেন প্রকল্পের সিলেট অংশের প্রজেক্ট ম্যানেজার দেবাশীষ রায় বলেন, প্রকল্পের কাজ এখন পর্যন্ত ১৫/১৬ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। আমাদের ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা ছিল। একারণে কাজ আশানুরুপ এগোয়নি।
এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক একে মোহাম্মদ ফজলুল করীম জানান- বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সময় বৃদ্ধি ও ক্ষতিপূরণের জন্য চিঠি দেয়া শুরু করেছে।
তবে সম্প্রতি সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম জানিয়েছেন, ২/৩ মাসের মধ্যে এই মহাসড়কের সিলেট অংশের ভূমি অধিগ্র্রহণ শেষ হবে। আর ৬ মাসের মধ্যে সড়কের কাজ পুরোদমে শুরু হবে।
সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক চারলেনে উন্নিতকরণ
আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক চারলেনে উন্নিতকরণের প্রকল্পটি নিয়েও হতাশা দেখা দিয়েছে। জমি অধিগ্রহণে আটকে আছে প্রকল্পের ভবিষ্যত। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল। কিন্তু এখনো প্রকল্পটির কাজ দৃশ্যমান হয়নি।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, উন্নয়ন বন্টনে সিলেট সবসময় পিছিয়ে ছিল। তাই উন্নয়নে সমতা আনতে প্রধান উপদেষ্টাসহ বর্তমান সরকারের উচিত সিলেটকে গুরুত্ব দেওয়া। অতীতে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সিলেট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের তদারকির অভাব ছিল। যেভাবে দায়িত্ব পালনের কথা ছিল তিনি সেভাবে করেননি। যে কারণে অনেক প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হয়নি, উল্টো থমকে গেছে।