বাতাসে মিশে থাকে এক অদৃশ্য গন্ধ। চায়ের সুবাস। সারি সারি সবুজ বাগান ঘেরা এই শহরের হৃদয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা নিলাম কেন্দ্র। বৃহস্পতিবারের সকাল ঘনাতেই চারপাশে জমে ওঠে উৎসবের আমেজ। ব্যবসায়ীদের কোলাহল, ব্রোকার্স হাউসের টুকরো টুকরো ডাক আর ক্রেতাদের অবিরাম পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে নিলাম প্রাঙ্গণ। এখানে প্রতিটি কেজি চা বিক্রি হয় শুধু টাকার বিনিময়ে নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শতবর্ষের ঐতিহ্য, শ্রমজীবী মানুষের ঘাম, আর বাংলার ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। প্রতিটি নিলাম যেন মনে করিয়ে দেয়, শ্রীমঙ্গল শুধু একটি শহর নয়, এটি চায়ের রাজধানী, যেখানে সংস্কৃতি আর অর্থনীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের ১৯তম নিলামটি যেন ছিল উৎসবের আরেক নাম। বিক্রির জন্য আনা হয়েছিল ১,১৫,৬২৩ কেজি চা। দুপুরের আগেই ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৯৩ টন চা বিক্রি হয়ে যায়। আর এই নিলামের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)-এর তৈরি গ্রীণ টি, যা প্রতি কেজি ১,২৫০ টাকায় বিক্রি হয়। এক কথায় নিলামের তারকা। অন্যদিকে হামিদিয়া চা বাগানের গুণগত মানসম্পন্ন ব্ল্যাক টি সর্বোচ্চ ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়ে ক্রেতাদের নজর কাড়ে। ক্রেতাদের ভিড়ে মুখর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা নিলাম কেন্দ্র।
জালালাবাদ, শ্রীমঙ্গল, রূপসী বাংলা, সোনার বাংলা ও জি এস। এ জেলার পাঁচ স্বনামধন্য ব্রোকার্স হাউস নিলামে অংশ নেয়। কারও হাতে গ্রীণ টি, কারও হাতে কালো চায়ের স্যাম্পল। দর হাঁকাহাঁকি, চোখাচোখি আর হিসাবের খাতা মেলাতে মেলাতে যেন তৈরি হয় আলাদা এক নাটকীয় আবহ। সোনার বাংলা ব্রোকার্স যখন বিটিআরআই-এর ১,২৯৩ কেজি গ্রীণ টি সর্বোচ্চ দামে বিক্রি করে, তখন পুরো হলে মুহূর্তের জন্য যেন একটুখানি শ্বাসরুদ্ধ নীরবতা নেমে আসে।
ক্লোনেল চা বাগানের তরুণ ব্যবস্থাপক রনি ভৌমিক বললেন, “নিলামকে আরও গতিশীল করতে সব বাগানকে একসাথে আনতে হবে। এতে বাজারে বৈচিত্র্য বাড়বে, চা শিল্পের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে।”
বাংলাদেশ চা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এম এস এন মুনিরের কণ্ঠেও আশাবাদ- “কিছু পরিবেশগত কারণে ক্রেতা কমলেও খুব শিগগির শ্রীমঙ্গলের নিলাম কেন্দ্রই হবে দেশের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র।”
২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উদ্বোধন করেছিলেন এ নিলাম কেন্দ্র। সেদিন থেকে শুরু হওয়া যাত্রা আজ শ্রীমঙ্গলকে শুধু দেশের নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারের সাথেও আরও গভীরভাবে যুক্ত করছে। বাংলাদেশ চা বোর্ড জানায়, চলতি অর্থবছরে দেশের তিনটি নিলাম কেন্দ্রে মোট ১২২টি নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে ৪৮টি আয়োজন হবে এখানেই, শ্রীমঙ্গলে।
নিয়মিত নিলাম অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়, যদিও এর কার্যক্রম নিয়ে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চা নিলাম কেন্দ্রটি চালু হওয়ার পর থেকে বাগান মালিক, ব্রোকার ও ব্যবসায়ীরা এখানে উপস্থিত হয়ে চা কেনাবেচা করেন, যা এই কেন্দ্রটিকে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মিলনস্থলে পরিণত করেছে।
চা কেবল একটি পানীয় নয়; এটি এক সংস্কৃতি, এক ঐতিহ্য, এক গর্ব। শ্রমিকদের হাতের ঘাম, বাগানের নীরব সবুজ, আর নিলাম হলের প্রাণচঞ্চলতা। সব মিলিয়ে শ্রীমঙ্গলের নিলাম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে চায়ের রাজধানী। এখানে বিক্রি হয় শুধু চা নয়, বিক্রি হয় স্বপ্ন, ইতিহাস আর বাংলাদেশের সুগন্ধময় পরিচয়।