শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

ধলাই সেতুর অস্তিত্ব সংকটে

অবৈধ বালু উত্তোলনে হুমকিতে দীর্ঘতম এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দীর্ঘতম ও দৃষ্টিনন্দন ধলাই সেতুর পাশ থেকে লাগাতার অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে সেতুটির ভবিষ্যৎ চরম সংকটে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এলাকাবাসীসহ উপজেলার সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যবসায়ী সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ, মিছিল এবং স্মারকলিপি প্রদান করলেও বালুখেকোদের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না। উল্টো বালু সিন্ডিকেটের হুমকি-ধমকিতে এখন প্রতিবাদকারীরাও ক্লান্ত।

জানা যায়, আলোচিত সাদা পাথর লঙ্কাকাণ্ডে তৎকালীন জেলা প্রশাসক, উপজেলা প্রশাসন এবং ওসি'র বিরুদ্ধে অবহেলা ও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠলে তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এরপর নবাগত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং ওসির যোগদানে কিছুটা সরব হলেও, বালু লুটপাটকারীদের তাণ্ডব সম্পূর্ণভাবে থামানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে সেতুটির নিরাপত্তা সংকট চরমে পৌঁছেছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ধলাইর দক্ষিণ বালুমহাল লিজ গ্রহীতা, নদীর তীর ও সেতু সংলগ্ন এলাকার কয়েকটি গ্রুপ একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি করে। এই সিন্ডিকেট প্রতিদিন দিন-রাতে শত শত স্টিলবডিতে ১০/১২ টাকা ফুট দরে বালু বেচাকেনা করছে। এতে প্রতিদিন কয়েক হাজার ফুট বালু বিক্রির মাধ্যমে বালুখেকো চক্র কয়েক লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

বিশেষ করে যন্ত্রদানব লিস্টার ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে ৫০/৭০ ফুট গভীর খাদ করে মধ্যরাত থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত মাঝারি নৌকা থেকে শুরু করে স্টিলবডি বড় নৌকায় দেদারসে সেতু এলাকা ও তীরবর্তী বাড়িঘর ধ্বংস করে নদীগর্ভে বিলীন করে দেওয়া হচ্ছে। এতে যেকোনো মুহূর্তে সেতুটির পিলার হেলে পড়লে বৃহৎ এলাকার একমাত্র সহজতম যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। এছাড়া কলাবাড়ী খেলার মাঠ, কবরস্থানসহ বহু বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীনের পথে।

সম্প্রতি দিন-রাতে বালু উত্তোলনের হিড়িক এবং অন্যদিকে অভিযানের খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় চাউর হলেও দুষ্কৃতকারীদের টনক নড়ছে না। স্থানীয় বাসিন্দা ও মাদ্রাসা শিক্ষক হাফিজ জামাল উদ্দিন তার ফেসবুক আইডিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে লেখেন, "ধলাই ব্রীজ তুমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? রাতের আঁধারে, বৃষ্টির সুযোগে দিনে রাতে সেতুর নিকটে বালু তুলার হিড়িক! মোবাইলে পোস্ট হয়, পুলিশ আয় তাড়ানি দেয় আবার হুলি শুর! হায় কি নিদারুণ তামাশা! আফসোস! মানুষের বিবেকের! সব ধ্বংস হোক আমার টাকা চাই।"

আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী জামিল আহমেদ জামিল কবিতার সুরে ক্ষোভ ঝেড়ে লেখেন, "ভাই ধলাই ব্রীজ রক্ষায় আন্দোলন করলেন! আন্দোলন প্রতিহত করলেন, তীব্র সমালোচনা করে রাস্তাঘাট গরম রাখলেন! এখন যখন সব আন্দোলন প্রতিবাদকারী থেমে গেলেন তো আপনিও চুপ হয়ে গেলেন! চুপ মানি চুপ একেবারেই চুপ! লুটেরারা খাবলে খাচ্ছে হামলে পরে! মাদকে সয়লাব আর ধলাই ব্রীজ বিলীনের পথে!"

স্থানীয় ব্রীজ রক্ষা আন্দোলন কমিটির পক্ষে এলাকাবাসী লুটপাটের চিত্র উপজেলা প্রশাসনকে অবগত করলে তাৎক্ষণিক অভিযানের খবর কোনো এক অদৃশ্য যোগসাজশে চাউর হয়ে যায়। তবে নতুন উপজেলা প্রশাসন টাস্কফোর্সের মাধ্যমে গত ১৫ দিনে অন্তত ১০টি অভিযানে ২০/২২ জন ব্যক্তিকে ছোট-বড় ১৫টির মতো স্টিলবডি ও নৌকাসহ আটক করে জেল-জরিমানা দিয়েছে। এতসব অভিযানেও বালুখেকোদের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না। একদিকে অভিযান শেষ হওয়ার ঘণ্টা দুয়েক পরেই ফের শুরু হয় বালু তোলার হিড়িক। এ যেন সেতু এলাকার বালুখেকো ও উপজেলা প্রশাসনের মধ্যে এক যুদ্ধাবস্থা।

এলাকাবাসী ও ব্রীজ রক্ষা আন্দোলন কমিটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সেতুটি হুমকির সম্মুখীন হওয়া থেকে বাঁচাতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত সেতু থেকে ৫০০ মিটার দূরত্ব সীমানা আনুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিতকরণ জরুরি। এতে এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সমন্বয়ে আনুষ্ঠানিক সীমানা পিলার ও পতাকা স্থাপন এবং স্থায়ী পুলিশ টহল না হলে এর গুরুত্ব ও বালুখেকোদের পেশীশক্তিকে দমন করা সম্ভব হবে না।

এদিকে, সেতু সংলগ্ন তীরবর্তী কলাবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা ফয়জুল হক নামের এক ব্যক্তি তার বাড়িঘরের পাশে বালু উত্তোলনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার উপক্রম হওয়ায় উপজেলা প্রশাসন বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, কয়েকদিন ধরে পার্শ্ববর্তী বালু বিক্রয়কারী একটি গ্রুপ কোটি টাকার বিনিময়ে দখলীয় খাস জমি মূল বালু উত্তোলন সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে। এতে অভিযোগকারীর বাড়িঘর হুমকিতে পড়েছে। নিষেধ করলে বালু উত্তোলনকারী দল তাকে হুমকি দেয়। ভুক্তভোগী ফয়জুল প্রশাসন কর্তৃক সকল নিরাপত্তার বিষয়ে সহায়তা কামনা করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভোলাগঞ্জ, ডাকঘর, নোয়াগাংগের পার, পাড়ুয়া ডাকঘর এলাকার কয়েকটি গ্রুপ সেতু এলাকায় দখলীকৃত অজুহাতে মূল বালু উত্তোলনকারী সিন্ডিকেটকে স্বল্পমূল্যে দিনরাত বালু উত্তোলনের সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে সেতুসহ নদী তীরের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রশাসনের স্থায়ী নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ব্রীজ রক্ষা আন্দোলন কমিটির নেতৃবৃন্দসহ উপজেলার সুশীল সমাজ।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিন মিয়া প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, ধলাই সেতু রক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিনিয়ত অভিযান চলমান রয়েছে এবং সেতুর পাশে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইনি মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসন তৎপর। তিনি আরও জানান, শীঘ্রই গুরুত্বপূর্ণ ধলাই সেতু রক্ষায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানোর প্রক্রিয়া চলমান।

কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি মো. রতন শেখ সেতু রক্ষায় এলাকাবাসীর দুর্বলতাকে দায়ী করেছেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্থানীয় ৯৫ ভাগ বাসিন্দা অর্থলোভে বালু লুটপাটের সঙ্গে জড়িত। তাদের আস্কারায়ই শত শত নৌকা, স্টিলবডি গভীর রাতে মত্ত থাকে। তিনি সার্বক্ষণিক পুলিশী নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে সামাজিক আন্দোলন ও এলাকাবাসীর সহযোগিতা কামনা করেছেন।

উল্লেখ্য, সিলেটের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধলাই সেতু ২০০৪-০৬ অর্থবছরে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের একান্ত প্রচেষ্টায় নির্মিত হয়েছিল। পূর্ব ধলাইয়ের দুটি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষের প্রাণের দাবি বাস্তবে রূপ নেয় সেতুটি উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। ফলে এখন ব্যবসা, যাতায়াতসহ সব মিলিয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সেতুটির রক্ষা।

এই সম্পর্কিত আরো