জাতীয় পরিচয়পত্রে তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয় যুক্ত হলেও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে এখনও তারা পরিচিত হন অবহেলার শিকার হিসেবে। সেবার জন্য হাসপাতালে গেলে হিজড়াদেরকে রোগীর পরিবর্তে বোঝা মনে করা হয়। অনেক সময় স্বাস্থ্যকর্মীরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, কেউ কেউ আবার সরাসরি সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানান।
এমন অভিযোগ সিলেটের তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর। এভাবে স্বাস্থ্যসেবার বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা হিজড়াদের জীবন প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
এ বিষয়ে সিলেটের হিজড়া জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বললে কারিশমা তানহা বলেন- আমাদের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, কিন্তু হাসপাতালে গেলে মনে হয় আমরা যেন অচেনা কোনো মানুষ। ডাক্তাররা অনেক সময় নীরব থাকেন, কেউ চোখ ফিরিয়ে নেন, আর কর্মচারীরা খোলাখুলিভাবেই হাসাহাসি করেন। রোগী হয়ে চিকিৎসা চাইতে গেলে আমাদের পরিচয়ই স্বীকার করতে চান না অনেকে। এভাবে অবহেলা আর অপমান সহ্য করা আমাদের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে।
এ বিষয়ে হিজড়া সম্প্রদায়ের আরেক সদস্য নাসরিন আখতার বলেন- গত মাসে আমি প্রচণ্ড জ্বরে অসুস্থ হয়ে ওসমানী মেডিকেলে যাই। রেজিস্ট্রেশনের সময় কর্মচারী আমার এনআইডি দেখে থমকে গেলেন। পাশের জনকে বললেন এদের কোথায় লিখব? এই লজ্জা-অপমান সহ্য করতে না পেরে আমি চিকিৎসা না নিয়েই চলে আসি।
এ বিষয়ে আশার আলো, সিলেট শাখার সভাপতি মাহফুজ আলম বলেন-হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি সমাজ ও স্বাস্থ্যখাতে যে বৈষম্য আজও বিদ্যমান, তা আমাদের জন্য সত্যিই গভীর উদ্বেগের বিষয়। রাষ্ট্র তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, হাতে জাতীয় পরিচয়পত্রও রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তারা হাসপাতালে গিয়ে বারবার অপমানিত হচ্ছেন এটা আমাদের সমাজের জন্য এক ধরনের ব্যর্থতা। একজন অসুস্থ মানুষ যখন চিকিৎসা নিতে আসেন, তখন তার একটাই পরিচয় হওয়া উচিত তিনি একজন রোগী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হিজড়াদের ক্ষেত্রে এই মৌলিক বিষয়টিও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি।
আমরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের অধিকার ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু শুধুমাত্র আইন বা কাগজে-কলমে স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়; চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিকতার পরিবর্তন সবচেয়ে জরুরি। পাশাপাশি সমাজকেও হিজড়া জনগোষ্ঠীকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে।
সরকার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্যকর্মী এবং সুশীল সমাজ—সবাই যদি সম্মিলিতভাবে এগিয়ে না আসে, তবে এই সম্প্রদায় বারবার বৈষম্যের শিকার হতেই থাকবে। আমরা চাই, হিজড়া জনগোষ্ঠী যেন হাসপাতালে গিয়ে নিজেদের অচেনা বা অবাঞ্ছিত মনে না করে, বরং অন্য সবার মতোই সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে চিকিৎসা নিতে পারে। এটি শুধু তাদের অধিকার নয়, বরং মানবিক দায়িত্বও
এ বিষয়ে সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন-হিজড়া জনগোষ্ঠী আমাদের সমাজেরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের কাছে হাসপাতালে আসা প্রত্যেক রোগীই সমান, তাই হিজড়া জনগোষ্ঠীকে কখনোই অবহেলা বা বৈষম্যের শিকার হতে দেওয়া যাবে না। আমরা নিশ্চিত করতে চাই, তারা যেন সবার মতোই সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে চিকিৎসা সেবা পান। সরকারি হাসপাতালগুলোতে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, এবং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিতভাবে এই বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে।
আমরা চাই, হিজড়া জনগোষ্ঠী হাসপাতালের পরিবেশকে নিরাপদ ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনে করুন। কোনো রোগী যেন নিজেকে অচেনা বা অবাঞ্ছিত অনুভব না করে, তা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। ভবিষ্যতে আমরা আরও কার্যকর উদ্যোগ নেব, যাতে তারা স্বাস্থ্যসেবার প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছন্দ্য ও মর্যাদা অনুভব করতে পারেন। আমাদের আশা, এই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠী চিকিৎসা নিতে এসে আত্মবিশ্বাসী এবং নিরাপদ বোধ করবেন, এবং সমাজের অন্যান্য নাগরিকদের মতোই সুষ্ঠু সেবা পাবেন।
এ বিষয়ে সিলেট শামসুদ্দিন হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন-হিজড়া জনগোষ্ঠী আমাদের হাসপাতালে এলে আমরা চেষ্টা করি তাদের জন্য একেবারেই বৈষম্যহীন সেবা নিশ্চিত করতে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য আলাদা সুবিধাও রাখা হয় তারা লাইনে দাঁড়াতে হয় না, সরাসরি জরুরি বিভাগে বা আমার কাছে আসেন, আর আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে দিই।
আমাদের কাছে রোগীর পরিচয় নয়, বরং তার অসুস্থতাই মুখ্য। তাই আমরা চাই তারা যেন কোনো বিব্রতকর অভিজ্ঞতার শিকার না হন। চিকিৎসার পাশাপাশি সম্মান ও মর্যাদাও তাদের প্রাপ্য, সেটি নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব।
হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীদের আমরা নিয়মিতভাবে সচেতন করি, যাতে তারা হিজড়া রোগীদের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়। আমরা চাই—তারা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা পাওয়ার পাশাপাশি মানসিক স্বস্তি নিয়েও ফিরে যান, যেন কখনো মনে না করেন এখানে তারা অবহেলিত বা অচেনা।
এ বিষয়ে সিলেট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন-হিজড়া জনগোষ্ঠীও আমাদের সমাজেরই একটি অংশ, তাই তাদের স্বাস্থ্যসেবার অধিকার অন্যদের মতোই সমানভাবে নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারি হাসপাতালগুলোতে তারা যেন কোনোভাবেই অবহেলা বা বৈষম্যের শিকার না হন, সেজন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়মিতভাবে এ বিষয়ে সচেতন করা হচ্ছে, যাতে তারা হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সম্মানজনক পরিবেশে চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন। আমরা চাই, তারা যেন হাসপাতালে এসে নিজেদের অচেনা বা অবাঞ্ছিত মনে না করেন, বরং স্বাভাবিক রোগীর মতো পূর্ণ সেবা পান। স্বাস্থ্যসেবা প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার, তাই হিজড়াদের ক্ষেত্রেও এ অধিকার সমানভাবে কার্যকর করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।