নীল আকাশের নিচে সাদা মেঘের মতোই ঝকঝকে দেখা যাচ্ছেতালতলা-বশিরপুর জামে মসজিদ। মসজিদের ছাদে সবুজ ও সোনালি রঙের গম্বুজগুলো যেন এই মনোরম দৃশ্যের শোভা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। প্রধান প্রবেশপথের উপরে এবং পাশে নীল কাঁচের জানালার নকশার স্থাপত্য এক বিশেষ আকর্ষণ যোগ করেছে। সামনের দেয়ালে দুটি ছবি - একটি মদিনা শরীফ আরেকটি মক্কা শরীফের কাবা ঘরের, যা মসজিদের পবিত্রতা ও তাৎপর্য তুলে ধরেছে। মসজিদের দুইদিকে নারকেল ও তালগাছ দাঁড়ানো যেন প্রকৃতি ও ধর্মীয় স্থাপনার এক সুন্দর মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে। সামগ্রিকভাবে এটি ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি স্থাপত্যশৈলী এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এক বিশেষ স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মসজিদ শুধু নামাজের স্থান নয়, বরং ২টি গ্রামের ৩টি পাড়া ও প্রায় ৩২০ পরিবারের মেলবন্ধনে পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আনুমানিক ৭শত বছর আগে এখানে প্রথমে একটি জুমা ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এটি জামে মসজিদ হিসেবে নামাঙ্কিত হয়। দীর্ঘকাল ধরে মসজিদটি স্থানীয় ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত ছিল।
সম্প্রতি স্থান সংকটসহ বিভিন্ন কারণে পুরনো স্থাপনাটি ভেঙে ২০২৩ সালে আধুনিক স্থাপত্যশৈলীতে পুনর্নির্মাণ করা হয়। বর্তমান মসজিদ ৩তলা ভিত্তিসহ ৫তলা সমান উঁচু একটি মিনার এবং ৩টি গম্বুজ নিয়ে দৃষ্টিনন্দন রূপে দাঁড়িয়েছে। যার দৈর্ঘ্য: ৬২ ফুট এবং প্রস্থ: প্রায় ৬০ ফুট। ভেতরে আধুনিক মার্বেল টাইলস, পর্যাপ্ত ফ্যান ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদে প্রায় ৭শত মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করার সু ব্যবস্থা রয়েছে। স্থানীয় ও প্রবাসীদের অর্থায়নে এ পর্যন্ত ১তলা বিশিষ্ট এ মসজিদ নির্মাণে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় মসজিদের দেয়াল, গেইট এবং এসি সংযোজনের জন্য আরও ৫০ লাখ টাকার বাজেট ধরা হয়েছে।
পুনর্নির্মাণ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য মো. আলাউদ্দিন, সাবেক ফুটবলার ও ক্রীড়া সংগঠক মো. সাহাজ উদ্দিন সাজু ও বর্তমান ইউপি সদস্য খন্দকার আব্দুর রকিব বলেন, এ মসজিদ আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ও একতার প্রতীক। আমরা গ্রামবাসী সবাই মিলে সেই ধারা ধরে রেখেছি। ২ গ্রামের ৩টি পাড়ার মানুষের একমাত্র জামে মসজিদ এটি।
বর্তমান ইমাম হাফিজ মাওলানা মোজাক্কির আহমদ জানান, ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে আমি দায়িত্ব পালন করছি। গ্রামবাসী মুরব্বিদের সম্মান করেন এবং তাঁদের পরামর্শ মেনে চলেন। এই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ঐক্য মসজিদের পরিবেশকে আলোকিত করেছে।
এ বিষয়ে প্রফেসর মো. বদরুজ্জামানের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, আমরা যুগ যুগ ধরে ঐক্যবদ্ধ। বহুবার নানা কারণে আমাদের পঞ্চায়েত ভাঙনের উপক্রম হলেও আল্লাহর রহমত ও আমাদের প্রচেষ্টায় আজও আমরা এক কাতারে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীতে কওমি ও আলিয়া উভয় ধারার মানুষ রয়েছেন। মতের ভিন্নতা থাকলেও আমরা পরস্পরের প্রতি সম্মান বজায় রেখেছি। মসজিদের ইমাম কওমি ঘরানার হলেও সবাই সমান অধিকার ভোগ করেন। মসজিদ নির্মাণে বাইরের কোনো অনুদান গ্রহণ করা হয়নি, এটি শুধুমাত্র স্থানীয় ও প্রবাসী সহযোগিতার ফল। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জেও এই সহযোগিতা আরও দৃঢ় হবে।
আরও কথা হয় আমেরিকা প্রবাসী সমাজসেবী ফজির আহমেদ আশরাফের সাথে। তিনি বলেন, মসজিদের নান্দনিক সৌন্দর্য সবার জন্য আনন্দের। প্রকৃত মর্যাদা নির্ভর করে খাঁটি নিয়ত ও ইখলাসের ওপর। এখানে ইবাদতের মাধ্যমে হিংসা-বিদ্বেষ ও অহংকার ত্যাগ করে ন্যায়-নীতি, মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের গ্রামবাসী ও তরুণ প্রজন্ম মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করবে এবং সমাজের কল্যাণে ভূমিকা রাখবে।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি ওবায়দুল হক সোহেলের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, সভাপতি খন্দকার আফতাব আলী খোকন, কোষাধ্যক্ষ মো. জমির আলি ও অন্যান্য সদস্যবৃন্দ আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্থানীয় ও প্রবাসী মুসল্লিদের সহযোগিতায় মসজিদের উন্নয়ন ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে চলছে। আলহামদুলিল্লাহ, মসজিদের নিজস্ব ৫২ শতক ভূমি রয়েছে, যার মধ্যে একটি পুকুরও অন্তর্ভুক্ত। পূর্বসূরিদের ঐক্যের ধারা আমরা অব্যাহত রাখার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।
এবং সভাপতি খন্দকার আফতাব আলী খোকন বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে মসজিদ এতদূর উন্নত হয়েছে—এটি সত্যিই কল্পনারও অতীত। গ্রামবাসীর আন্তরিক সহযোগিতা এবং প্রবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। এখনো কিছু কাজ বাকি রয়েছে—দেয়াল, গেইট ও অন্যান্য উন্নয়ন। ইনশাআল্লাহ, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই তা সম্পন্ন হবে।