সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালে প্রায় আড়াই কোটি টাকার ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। এই ঘটনায় মঙ্গলবার বিকালে ১০ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কীভাবে এতো ওষুধ গোডাউনে গেছে, এই তথ্যের কোন ডকুমেন্ট দেখাতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের সরকারি বিনামূল্যের ওষুধ না দিয়ে বাইরে ওষুধ পাচার হয় এমন তথ্য ইতোমধ্যে দুদকের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে।
সেবা নিতে আসা রোগীদের ওষুধ না দেয়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে এমন অভিযোগ করেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। এতে সরকারি বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে। এছাড়াও স্টোর কিপারের পদে একজন থাকলেও স্টোরের দায়িত্ব পালন করছেন মেডিকেল টেকনেশিয়ান, সিনিয়ার স্টাফ নার্স পদের সাতজন।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে প্রতিদিন সেবা নিতে আসেন হাজারো মানুষ। হাসপাতালে ভর্তি থাকা তিনশ রোগী সেবা নেন প্রতিদিন। অভিযোগ ওঠেছে, সেবা নিতে আসা রোগীদের বেশিরভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়।
রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ না দেয়ার কারণে প্রায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ টাকার মূল্যের ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এই ঘটনায় মঙ্গলবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১০ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান হয়েছেন হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আশুতোষ সিংহ। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. সুমন বণিক অফিসের কাজে ঢাকা থাকায় দায়িত্বে থাকা সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. বিষ্ণু প্রসাদ চন্দ সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।
আবাসিক মেডিকেল অফিসারের অফিসের পাশেই স্টোর রুমে পাওয়া যায় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। এসব কার্টন ভর্তি ওষুধের কোনোটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ৬ মাস আগে। আবার কোনোটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে।
এছাড়াও হাসপাতালের পুরাতন ভবনের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে মিললো এরচেয়ে দ্বিগুণ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ। এসব ওষুধের মেয়াদও এক বছর আগে থেকে দুইদিন আগেও কোন কোনটির মেয়াদ শেষ হয়েছে।
স্টোর কিপারের দায়িত্বে থাকা রাজন দে জানান, তিনি মূলত এনেসথেসিয়া টেকনিশিয়ান (মেডিকেল টেকনিশিয়ান)। তিনি স্টোরের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। জানা গেছে, হাসপাতালের স্টোরের দায়িত্বে রাজন দে’সহ আরও ৭ জন রয়েছেন।
এদের মধ্যে রয়েছেন সিনিয়র স্টাফ নার্স সোহেল আহমেদ, আতিক আহমদ, মুবিন আনসারী, মেডিকেল টেকনিশিয়ান সাদেক আহমদ, রুম্মান মিয়া ও পিযুষ দেবনাথ। তবে হাসপাতালের স্টোর কিপার রুপম কুমার দাস সাংবাদিকদের জানান, তিনি চলতি বছরের মার্চ মাসে হাসপাতালে যোগদান করেছেন। তিনি হাসপাতালের আসার পর দায়িত্ব সমঝে দেওয়া হয়নি। তার দায়িত্ব পালন করছেন হাসপাতালের অন্য দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
যে ওষুধগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে সেগুলো হলো, Syp. Kitomar রয়েছে ১ হাজার পিস। এটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে। Tab. Cefuroxime 250mg রয়েছে ৫০ হাজার ৭৫০ টি। Tab. Bisoprolol 5mg রয়েছে ২২ হাজার ৩২০ টি। Tab. Montelukas 10mg রয়েছে ছয় হাজার। Tab. Montelukas 4mg রয়েছে এক লক্ষ পিস। Tab. N-Bion রয়েছে ১৬ হাজার পিস। Tab. Rosuba 5mg রয়েছে ৫৩ হাজার ছয়শ’ পিস। Tab. Fexofenadin 120mg রয়েছে ২২ হাজার চারশ’ পিস। Tab. Naproxen 500mg রয়েছে দুই লাখ ৫২ হাজার চারশ’ পিস। Tab. Atorvastatin 10mg রয়েছে তিন লাখ ৬৭ হাজার পিস। Tab. Rabeprazole 20mg রয়েছে ১০ হাজার পিস। এই ওষুধগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে গেল এপ্রিল মাসে। Tab. Glucozid 80mg রয়েছে ২৫ হাজার ৬শ পিস। Tab. Lopiral Plus 75mg রয়েছে আট লাখ ৯১ হাজার পিস। এই দুই রকমের ওষুদের মেয়াদ শেষ হয়েছে বিগত মার্চ মাসে। Inj. Ceftriaxone 250mg রয়েছে ২২ হাজার পিস। এটির মেয়াদ শেষ হয়েছে চলতি বছরের জুন মাসে। Tab. Esoral 20mg রয়েছে ১৮ হাজার নয়শ’ পিস। এটির মেয়াদ শেষ হয়েছে দুইদিন আগে (৩১ আগস্ট পর্যন্ত ছিল মেয়াদ)। এই পনেরো পদের ওষুধগুলোর বাজার মূল্য প্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা। এই তালিকার বাইরেও আরও অনেক মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রয়েছে হাসপাতালের স্টোর রুমে।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরা বলছেন, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে ভর্তি হলেও, বেশিরভাগ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। এতে বেশি বিপাকে পড়েন দরিদ্র ও অসচ্ছল রোগীরা।
গৌরারং ইউনিয়নের কান্দিগাঁও গ্রামের জনৈক বাসিন্দা বলেন, বাইরে থেকে স্যালাইন কিনে আনতে বলা হয়েছে। আমরা বলেছি হাসপাতাল থেকে দিতে। তারা বলেছে হাসপাতালে নেই, বাইরে থেকে কিনতে হবে।
স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী মুজাহিদুল ইসলাম মজনু সাংবাদিকদের বলেন, স্টোরে কোটি টাকার ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অবহেলিত একটি এলাকা সুনামগঞ্জ। এখানে প্রতিদিন প্রায় এক থেকে দেড় হাজার রোগী আউটডোরে সেবা নেন।হাসপাতালে ভর্তি থেকেও সেবা নেন বহু রোগী। এতো রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসার পরেও কেনো কোটি কোটি টাকার ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণ হলো তা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে খোঁজে বের করার দাবি জানাচ্ছি।
ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. বিষ্ণু প্রসাদ চন্দ বলেন, এটি অস্বাভাবিক একটি ঘটনা, এতো টাকার ওষুধ কিভাবে নষ্ট হলো, এ বিষয়ে হাতপাতালের তত্ত্বাবধায়ক তদন্ত কমিটি করেছেন।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. সুমন বণিক বলেন, আগের তত্ত্বাবধায়ক বদলি ও নতুন তত্ত্বাবধায়ক যোগদান না করায় আমি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বে রয়েছি। ওষুধগুলো অনেক আগে কেনা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। এখন করণীয় বিষয়ে কমিটি সিদ্ধান্ত দেবে।