বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

ফুটবল মাঠে আলো ছড়াচ্ছে চা বাগানের মেয়েরা

দারিদ্র্যের শৃঙ্খল ভেঙে ফুটবল মাঠে আলো ছড়াচ্ছে সিলেটের চা বাগানের কিশোরীরা। চা শ্রমিক পরিবারের এই কন্যারা প্রতিভা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে খেলাধুলায় জায়গা করে নিচ্ছে।তারা খেলাধুলায় নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করে দেখাচ্ছে—চা শ্রমিক পরিবার থেকেও স্বপ্ন পূরণ সম্ভব।

সিলেট বিভাগের অনুর্ধ-১৭ মহিলা ফুটবল দলে জায়গা করে নিয়েছে বিথী নায়েক ও পপি নায়েক, আর বৈশাখী নায়েক খেলে চলেছে সিলেট উপজেলা মহিলা ফুটবল দলে। তিনজনই চা শ্রমিক পরিবারের সন্তান।

বিথী নায়েক নবম শ্রেণির ছাত্রী। তার বাবা বকুল নায়েক ও মা শ্যামলী নায়েক দুজনেই চা শ্রমিক। পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবলেও নিজের অবস্থান তৈরি করছে সে। পপি নায়েক অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা কানাই নায়েক ও মা পাপলা নায়েকও চা শ্রমিক। নিয়মিত অনুশীলন ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে পপিও বিভাগীয় দলে জায়গা করে নিয়েছে।

বৈশাখী নায়েক, বয়স ১২ বছর, বুরজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। শৈশবেই বাবাকে হারানোর পর চা শ্রমিক মা জয়া নায়েকের সামান্য আয়ে সংসার চলে। তবু বৈশাখী হাল ছাড়েনি। দুই বছর ধরে হিমু ফুটবল একাডেমিতে অনুশীলন করে আসছে এবং বর্তমানে উপজেলা দলের হয়ে মাঠে নামছে।

তাদের সাফল্য শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি এক প্রেরণার গল্প। বিশেষ করে তাদের মতো দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া পরিবারের মেয়েদের জন্য তারা আজ এক অনুপ্রেরণার নাম।তারা জানে সামনের পথ সহজ নয়। তবুও তাদের চোখে ভর করে আছে একটাই লক্ষ্য—ভালো খেলোয়াড় হয়ে জাতীয় দলে খেলা। পাশে থেকেছেন কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী, যারা তাদের এগিয়ে যেতে সাহস যোগাচ্ছেন।

চা শ্রমিক পরিবারের এই তিন মেয়ে সম্পর্কে প্রত্যাশা সমাজ কল্যাণ যুব সংঘের সভাপতি সাইদুল ইসলাম সোহেল এই প্রসঙ্গে বলেন, ইনশাআল্লাহ, তারা একদিন শুধু বড় খেলোয়াড়ই হবে না, বরং আমাদের সমাজের প্রতিটি মেয়ের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠবে। এই তিন মেয়ের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি জয় ও প্রতিটি সাফল্য আমাদের সমাজের মেয়েদেরকে দেখাবে যে, সঠিক চেষ্টা ও দৃঢ় মনোবল থাকলে কেউই কোনো বাধার সামনে হার মানে না। তাদের স্বপ্ন পূরণে আমি আমার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে পাশে থাকব। চাই যেন তারা প্রতিটি বাধা পেরিয়ে আরও দৃঢ়, আরও আত্মবিশ্বাসী ও আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে এগোতে পারে। আমি আশা করি, এই তিন মেয়ে কেবল নিজের জীবনের জন্য নয়, বরং আমাদের সমাজের প্রতিটি মেয়ের স্বপ্ন ও আশা বাস্তবায়নের পথও প্রশস্ত করবে। তাদের এই সংগ্রাম আমাদের সমাজের জন্য এক শক্তিশালী প্রেরণা হয়ে থাকবে, যা নতুন প্রজন্মকে সাহস, আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতার সঙ্গে স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলার প্রেরণা দেবে।

৩নং খাদিমনগর ইউনিয়নের সদস্য আতাউর রহমান শামিম বলেন—চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের মেয়েরা আজ  ফুটবল দলে জায়গা করে নিয়েছে, এটি শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, আমাদের পুরো এলাকার জন্যই গর্বের বিষয়।


তিনি বলেন- ছোট্ট বয়সেই বাবাহারা পরিবারের মেয়ে হয়ে বৈশাখী যে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসছে, তা সত্যিই অনুকরণীয়। জীবনের নানা অভাব-অনটন আর সীমাবদ্ধতা তাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, বরং প্রতিদিনের কষ্টই সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জুগিয়েছে।আমি বিশ্বাস করি, তাদের এই সাফল্য অন্য অনেক ছেলেমেয়ের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা তাদের পাশে থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করব। প্রয়োজন হলে প্রশিক্ষণ, খেলার সরঞ্জাম, এমনকি পড়াশোনার বিষয়েও সহযোগিতা করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমরা চাই, তারা শুধু জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়েই নয়, জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করুক। তাদের সাফল্য প্রমাণ করবে যে চা বাগানের সন্তানরাও সুযোগ পেলে যেকোনো ক্ষেত্রে নিজেদের মেলে ধরতে সক্ষম। এই অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রমই একদিন তাদেরকে বড় খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে, ইনশাআল্লাহ।

এ বিষয়ে আর, ডব্লিউি, ডিও, সিলেটের নিবার্হী পরিচালক সমীতা বেগম মীরা বলেন -এই তিন মেয়ে যে দৃঢ় সংকল্প, অদম্য সাহসিকতা এবং অনন্য প্রতিভার সঙ্গে ফুটবল খেলছে, তা আমাদের সমাজের জন্য এক নতুন আশা এবং অনুপ্রেরণার প্রতীক। সত্যি বলতে, আগে তাদের সম্পর্কে কিছু জানতাম না, এখন তাদের সংগ্রাম ও দৃঢ় মনোবল দেখে খুবই ভালো লাগছে। তারা প্রমাণ করছে, চ্যালেঞ্জ যতই বড় হোক না কেন, যদি ইচ্ছাশক্তি এবং পরিশ্রম থাকে, তবে কোনো সীমা অসম্ভব নয়। তাদের এই উজ্জ্বল প্রতিভা শুধু খেলাধুলার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সমাজের প্রতিটি মেয়ের স্বপ্নকে এগিয়ে নেওয়ার পথপ্রদর্শক হবে। আমি তাদের সফলতা, অধ্যবসায় এবং সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে যুক্ত মনে করি। আশা করি, তারা প্রতিটি বাধা পেরিয়ে আরও শক্তিশালী, আত্মবিশ্বাসী এবং সমাজকে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হয়ে উঠবে। এই তিন মেয়ে আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে, যে সাহস, অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রম একসাথে মিললে স্বপ্ন কেবল দেখা নয়, বাস্তবেও রূপ নেওয়া সম্ভব।

আর, ডব্লিউি, ডিও, সিলেটের প্রকল্প সমন্বয়ক মো: জাহিদুল ইসলাম রশিদ বলেন -এই তিন মেয়ে শুধু ফুটবল খেলছে না, তারা আমাদের সমাজে স্বপ্ন দেখার এবং সেই স্বপ্ন পূরণের শক্তিকে নতুনভাবে ফুটিয়ে তুলছে। তাদের খেলার ধরনে যে সততা, ধৈর্য ও সাহস দেখা যাচ্ছে, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি প্রতিভা সঠিক পরিচর্যা পেলে কতদূর যেতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, তারা কেবল নিজেরাই নয়, গ্রামের ছোট মেয়েরা, স্কুলের কিশোরীসহ সমাজের প্রতিটি তরুণী তাদের থেকে অনুপ্রেরণা নেবে। প্রতিটি অনুশীলন, প্রতিটি জয় বা পরাজয় তাদের শেখাচ্ছে যে সীমাবদ্ধতা মানে হার নয়, বরং আরও দৃঢ় হওয়ার সুযোগ। আমরা সবাই তাদের পাশে আছি, যেন তারা শুধু মাঠে নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষমতার পূর্ণ সম্ভাবনা প্রকাশ করতে পারে।

এ বিষয়ে তাদের পরিবারে সাথে কথা বললে বৈশাখীর জয়া নায়েক বলেন -আমার মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই অনেক কষ্ট দেখে বড় হয়েছে। তার বাবা নেই, সংসারে অভাব আছে, তবুও ওর স্বপ্ন থামাইনি। মাঠে খেলার সময় ওকে দেখে আমার বুক ভরে যায়। আমি চাই ও যেন পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবলেও আরও এগিয়ে যায়। যদি সুযোগ পায়, একদিন বড় খেলোয়াড় হবে—এই আশা নিয়েই বাঁচি।

হিমু ফুটবল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এম এ সালাম হিমু বলেন - আমরা সুবিধাবঞ্চিত ফুটবলারদের নিয়ে কাজ করছি, বিশেষ করে চা শ্রমিকদের সন্তানদের নিয়ে। বৈশাখী, বিথী আর পপি আজ উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় দলে খেলছে—এটাই প্রমাণ করে, সুযোগ পেলে ওরা অনেক দূর যেতে পারবে। আমি বিশ্বাস করি, একদিন এদের মধ্য থেকেই জাতীয় দলের খেলোয়াড় তৈরি হবে।

চা বাগানের শ্রমিক পরিবার থেকে উঠে আসা এই কিশোরীদের গল্প শুধু একটি পরিবারের নয়, এটি একটি সমাজেরও গল্প। যেখানে অভাব, কষ্ট আর সামাজিক বাধা সত্ত্বেও মেয়েরা খেলাধুলায় নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে।

এই সম্পর্কিত আরো