সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর লুট নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সিলেট জেলা প্রশাসককে (ডিসি) শের মাহবুব মুরাদকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। এছাড়া কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহারকে ফেঞ্চুগঞ্জে বদলি করা হয়েছে।
সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে পৃথক প্রজ্ঞাপনে এসব তথ্য জানানো হয়।
ডিসি মুরাদ ও ইউএনও আজিজুন্নাহারের বিরুদ্ধে সিলেটের পাথর লুট ঠেকাতে ব্যর্থতা ও উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে। তারা লুটপাটকারীদের প্রশ্রয় দেন বলেও অভিযোগ আছে। এছাড়া সম্প্রতি ডিসি মুরাদ সিলেটের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীরও বিরাগভাজন হন।
জানা যায়, সোমবার বিকেলে যখন সিলেটের ডিসি’র ওএসডি ও কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও বদলির খবর গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছিলো তখন দুজনই সাদাপাথর এলাকায় ছিলেন।
বিকেলে ইউএনওকে নিয়ে সাদাপাথর পরিদর্শনে যান ডিসি মুরাদ। তারা পাথর লুট হওয়া এলাকা কিছু সময় পরিদর্শন করেন। এরপর গণমাধ্যমের সথেও কথা বলেন জেলা প্রশাসক।
এসময় তিনি বলেন, সাদাপাথরের লুট হওয়া পাথর উদ্ধার অভিযান চলছে। উদ্ধার হওয়া পাথর এই স্থানে ফিরিয়ে এনে সাদাপাথরকে আগের অবস্থায় ফইরয়ে আনা হবে। পাথর লুট ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক যখন গণমাধ্যমের সাথে কথা বলছিলেন তখনই তার ওএসডির খবর আসে।
তবে এরপর জেলা প্রশাসক মুরাদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সোমবার (১৮ আগস্ট) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ডিসি মুরাদকে ওএসডি করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
মুরাদের বদলে সিলেটের নতুন ডিসি হিসেকে পদায়ন করা হয়েছে আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারোয়ার আলম।
শের মাহবুব মুরাদ গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। তার সময়েই সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ ও সাদাপাথরসহ বিভিন্ন কোয়ারি থেকে ব্যাপক বালু ও পাথর লুটের অভিযোগ রয়েছে।
সাদাপাথরে নজিরবিহীন পাথর লুট নিয়ে সাম্প্রতি দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এরপর থেকেই পাথর লুটপাটে প্রশাসনের উদাসীনতা ও ব্যর্থতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
রোববার পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানও বলেন, পাথর লুটে স্থানীয় প্রশাসনের দায় রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবেশ উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পরদিনই সিলেটের জেলা প্রশাসককে বদলি করা হলো।
একইদিনে কোম্পানীগঞ্জের উপজেলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহারকেও বদলি করা হয়েছে। সাদাপাথরে ব্যাপক লুটপাটে ব্যপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন এই ইউএনও। লুট ঠেকাতে ব্যর্থতা ও উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
বৃহস্পতিবার সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজাউন নবী সাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে আজিজুন্নাহারকে কোম্পানীগঞ্জ থেকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় বদলি করা হয়। অপরদিকে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বর্তমান ইউএনও মো. শফিকুল ইসলামকে কোম্পানীগঞ্জে পদায়ন করা হয়েছে।
আজিজুন্নাহার চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও হিসাবে যোগদান করেন। এরপর সাদাপাথর ও ভোলাগঞ্জে ব্যাপক লুটপাট হয়। এনিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে সমালোচনা হয়। সমালোচনার মুখে ১২ আগস্ট জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে ইউএনও আজিজুন্নাহারকে সদস্য রাখা হয়। যার বিরুদ্ধে লুটপাট ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাকে কমিটিতে রাখায় এই কমিটি নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।
এদিকে, সম্প্র্রতি ফেসবুকে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। যাত দেখা যায়, আনসার সদস্যদের নিয়ে সাদা পাথরে অবস্থান করছেন ইউএনও আজিজুন্নাহার। তার সমনেই নৌকায় করে পাথর লুট করে যাওয়া হচ্ছে। তবে লুটপাটে আজিজুন্নাহারকে কোন বাধা দিতে দেখা যায়নি।
জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকেই ভয়াবহ লুটপাটের শিকার হয়েছে সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর এবং এর পাশের ১০ একরের রেলওয়ে বাঙ্কার। স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় শুরুর দিকে রাতে লুট হলেও সম্প্রতি দিনে-রাতে সব সময়ই হয়েছে। ফলে একেবারে পাথর শূন্য হয়ে পড়েছে সাদাপাথর পর্যটন এলাকা। আর খানাখন্দে পরিণত হয় রেলওয়ে বাঙ্কার।
স্থানীয়দের মতে, এই দুই স্থান থেকে কমপক্ষে দেড় কোটি ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ২০০ কোটি টাকার বেশি।
স্থানীয়রা জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে যে লুটপাট শুরু হয় তা থামাতে প্রশাসনের লোক দেখানো অভিযান ছাড়া কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। ইউএনও হিসাবে আজিজুন্নাহার যোগদান করেন এ বছরের ১৪ জানুয়ারি। এরপর অজানা কারণে সেই অভিযান আরও শিথিল হয়। এমন শিথিলতার কারণেই ধীরে ধীরে লুটপাটকারীরা তাদের লুটের মাত্রা আরও বাড়ায়। তাই যার অবহেলায় এমন লুটের ঘটনা তাকে দিয়ে তদন্ত করা হাস্যকর মনে করেন তারা।
সাদাপাথরে নজিরবিহীন লুটপাটে প্রশাসনের দায় দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)।
গত বুধবার সাদাপাথর পরিদর্শন শেষে দুদকের সিলেট কার্যালয়ের উপ পরিচালক রাফি মো. নাজমুস সাদাত বলেন, এখানে স্থানীয় প্রশাসন আরও সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিলো। তাদের আরও কার্যকর ভূমিকা রাখা দরকার ছিলো।