অনেক স্বপ্ন আশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল স্নেহা। সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (CSE) বিভাগে ভর্তি শেষে বুধবার ৬ আগস্ট অটোরিকশাযোগে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি।
ফেরার পথে ঘাতক বাস কেড়ে নিল তার সেই লালিত স্বপ্ন। স্নেহা বাড়ি ফিরল ঠিকই তবে প্রাণহীন নিথর দেহে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাবা নিজ হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছিলেন গাড়িতে। ঘাতক বাস কেড়ে নিল স্নেহাসহ তিনটি তাজা প্রাণ। গুরুতর আহত হন আরও দুই যাত্রী। তাদেরকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের বাহাদুরপুর এলাকায় বাস ও সিএনজি চালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।
তার বাবার নাম বিপুল চক্রবর্ত্তী। তিনি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার আস্তমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস গ্রামের বাসিন্দা।
স্নেহা ২০২২ সালে সুনামগঞ্জ সরকারি এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সরকারি কলেজ থেকে এইচ এসসি পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।
নিহত স্নেহার মা জয়ত্রী রাণী চক্রবর্তী জানান, স্নেহা এবার সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছে। আজ ছিলো তার ভর্তির দিন। সকালে বাবার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলো সে।এভাবে স্নেহার চলে যাওয়া মানতে পারছেননা তিনি। তাই মেয়ের কথা স্মরণ করে হাসপাতালে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মা।
স্নেহাকে হারিয়ে তার পরিবারে চলছে শোকের মাতম।স্বজনদের আহাজারিতে চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
এদিকে জন্মদিনেই সড়কে প্রাণ ঝরলো আফসানা জাহান খুশির। তিনি সুনামগঞ্জ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট-এ ডিপ্লোমা দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং শহরের আরফিন নগর এলাকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য দেলোয়ার হোসেন ও নুরুন্নাহার দম্পতির মেয়ে।
তাঁদের দুই মেয়ের মধ্যে আফসানা ছোট। বড় মেয়ে নুসরাত জাহানের বিয়ে দেয়া হয়েছে।
তাঁর স্বজনরা জানান, দুর্ঘটনার দিন ৬ আগস্ট ১৯ তম জন্মদিন ছিল তার। তাই বাড়িতে জন্মদিন পালনের প্রস্তুতি ও নেওয়া হয়েছিল।
নিহত খুশির বাবা দিলোয়ার হোসেন বলেন, ৬ আগস্ট আমার মেয়ের জন্মদিন ছিলো। আমরা তাকে ক্লাসে যেতে নিষেধ করেছিলাম। সে বললো তার জন্মদিন উদযাপনের আয়োজন করেছে বান্ধবীরা। সে সকাল সকাল ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আর ফিরে এলো না। আমার সব শেষ। আমি এখন কারে নিয়ে বাঁচবো।
আফসানা জাহান খুশির মামা সাইফুল আলম ছদরুল বলেন, আফসানা মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলো। সুনামগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ থেকে লেখাপড়া করে গত বছর সুনামগঞ্জ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিল। এবার দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলো সে। প্রতিদিন শহর থেকে অটোরিকশায় যাতায়াত করতো।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আফসানা জাহান খুশির লাশের পাশে তাঁর ব্যাগটি পড়ে ছিল। এটি বাড়িতে এনে খুলে দেখা যায়, ভেতরে জন্মদিনের অনেক উপহার। তাঁর ছবি যুক্ত করে সহপাঠীরা দিয়েছেন কোনোটি। ‘মেয়েটা অনেক মেধাবী ছিল। তাঁর আশা ছিল, পড়াশোনা করে বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে; কিন্তু মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল।’
অপর নিহত শহরের আলীপাড়া এলাকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম (৫৫)। তাঁর পরিবারেও চলছে শোকের মাতম। নিহত তিনজনই একই অটোরিকশার যাত্রী ছিলেন।
অনিরাপদ সড়ক নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ট্রাফিক আইন অমান্য করা, অদক্ষ চালকসহ বিভিন্ন অনিয়ম এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।
শুধু পুলিশ প্রশাসন দিয়ে সড়ক নিরাপদ করা সম্ভব নয় জানিয়ে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সৈকত দাস বলেন, প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ ছাত্রজনতাকেও সড়কে নেমে আসতে হবে। ফিটনেসবিহীন পরিবহন যাতে সড়কে আর চলতে না পারে এ জন্য কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তবেই সড়কে দুর্ঘটনা কমে আসবে।