স্বামী বিদেশে, আর স্ত্রী দেশে। টাকা আসে ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে আসে দীর্ঘশ্বাস, একাকীত্ব আর শত দায়িত্বের ভার। হাজারো নারী প্রতিদিন লড়ছেন এই বাস্তবতার সঙ্গে। তারা প্রবাসীর স্ত্রী—যারা শুধু সংসার সামলান না, সন্তান ও শ্বশুরবাড়ির দায়িত্ব একা কাঁধে নিয়ে চলেন বছরের পর বছর।
প্রবাসে স্বামীর পাঠানো টাকায় সংসার চলে ঠিকই, কিন্তু সেই টাকার পেছনের গল্পটা অনেক গভীর। আর দেশে থেকে যে নারী দিনশেষে সন্তানদের হাসিমুখ দেখে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন, তিনি একাই চালিয়ে যাচ্ছেন একটানা দুই ভূমিকা—একজন মা এবং একজন বাবার।
সন্তানদের লেখাপড়া, খাওয়া-দাওয়া, অসুস্থতা, স্কুলে অভিভাবক সমাবেশ—সব দায়িত্ব একাই সামলাতে হয় প্রবাসীর স্ত্রীদের। আবার পরিবারের বয়স্ক শ্বশুর-শাশুড়ির দেখভাল, সমাজের নানা চাপ, আত্মীয়-প্রতিবেশীর কথারও শুনতে হয় চুপচাপ।
তবুও তারা ভাঙেন না—লড়েই যান।
প্রবাসীর স্ত্রী রাহেলা বেগম বলেন-দুই সন্তানকে ঘিরেই আমার সংসার। টাকাটা সময়মতো আসে ঠিকই, কিন্তু আসে না মানসিক শান্তি কিংবা রাতের ঘুম। জমির কাগজ হোক বা স্কুলের ফিস, বাজারের দরদাম থেকে শুরু করে সামাজিক পরিস্থিতি—সব একা সামলাতে হয় আমাকে। স্বামীকে ফোন দিলে কথা হয় মাত্র দু’মিনিট, তারপর লাইন কেটে গেলে চারদিকে শুধু নিঃসঙ্গ নীরবতা।
প্রায় সাত বছর ধরে একাই সব কিছু সামলাই। কেউ বোঝে না এই একা থাকার যন্ত্রণা। বাচ্চারা এখন বাবার মুখও চিনে না। মানুষ ভাবে টাকার অভাব নেই, সুখেই আছি—কিন্তু আমি তো শান্তি পাই না....—বলে কান্না চেপে রাখেন সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার রাহেলা বেগম।
গ্রামে একা থাকা একজন প্রবাসীর স্ত্রী মানেই যেন সমাজের চোখে সবসময় সন্দেহের অবজেক্ট। বাজারে গেলে কেউ না কেউ কথা তো বলবেই, কারও সঙ্গে ফোনে কথা বললেও সন্দেহ জাগে। অথচ তিনিই সেই নারী, যিনি এক হাতে সন্তান লালন করেন, অন্য হাতে টানেন পুরো সংসারের ভার।
নিরবে যিনি যুদ্ধ করে চলেছেন প্রতিদিন, তাকেই যেন সমাজ ভুল বোঝে সবচেয়ে বেশি।
সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরলে এমন হাজারো পরিবারের দেখা মেলে, যেখানে পুরুষ অভিবাসী আর নারী হয়ে উঠেছেন পরিবার চালনার মুখ্য ব্যক্তি।
নগরীর কলাপাড়া এলাকার বাসিন্দা রোকেয়া বেগম বলেন- স্বামী সাত বছর ধরে ওমানে। সংসারের ছোট-বড় সব কাজ এখন আমাকেই দেখতে হয়। ছেলের স্কুলে যাওয়া, মেয়ের চিকিৎসা, বাজার করা—সবই আমি করি। সমাজে কেউ পাশে থাকে না, উল্টো বিচার করে।
আম্বরখানা বড় বাজারের বাসিন্দা সাবিনা আক্তার বলেন-স্বামী বিদেশে, আর আমি দেশে। সন্তানদের নিয়ে একাই সব সামলাতে হয়। বাইরে থেকে যতই শক্ত দেখাই, ভেতরে ভেতরে অনেক কষ্টে থাকি। রাতের বেলায় যখন সব কিছু নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন সেই একাকীত্বটা আরও তীব্রভাবে টের পাই। প্রতিদিন নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করি, কারণ সন্তানদের জন্য আমাকে টিকে থাকতে হয়। এভাবেই আমার জীবন চলছে—নিঃসঙ্গতায় ভরা এক লড়াই।
এমন নারীরা কেবল গৃহিণী নন—তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সম্পদ দেখভাল করেন, সন্তান মানুষ করেন। সন্তানদের স্কুলে ভর্তি, অভিভাবক সমাবেশে উপস্থিতি থেকে শুরু করে সামাজিক অনুষ্ঠানেও একাই অংশ নিতে হয়। অনেক সময় সন্তানদের কাছে মায়ের পাশাপাশি বাবার ভূমিকাও পালন করতে হয়।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন—প্রবাসীর স্ত্রীদের জীবনে প্রতিনিয়ত এক ধরনের নীরব যুদ্ধ চলে। স্বামী দেশের বাইরে থাকায় তাদের একাই সংসার সামলাতে হয়, সন্তানদের বড় করতে হয়, আবার সমাজের নানা চাপ ও প্রতিকূলতারও মুখোমুখি হতে হয়। এই দ্বৈত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সময় তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ তাদের এই ত্যাগ ও সংগ্রাম সমাজে অনেক সময় অদৃশ্যই রয়ে যায়। প্রবাসী পরিবারের এই নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। শুধু অর্থ নয়, তাদের জীবনের গল্প ও বাস্তবতা নিয়েও আমাদের সমাজকে ভাবতে হবে।
অন্যদিকে, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়—স্বামী দেশে ফিরলে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়। বছরের পর বছর একা দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া স্ত্রী আবারো ‘নীরব’ হতে বাধ্য হন পারিবারিক কাঠামোর চাপে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নারীরা শুধু প্রবাসীর স্ত্রী নন—তারা হলেন সমাজের ‘অদৃশ্য চালিকা শক্তি’। কিন্তু তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি নেই কোথাও। না রয়েছে কোনও নীতিমালা, না রয়েছে সুরক্ষা।
এ বিষয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ওয়াজিমা চৌধুরী বলেন—প্রবাসীর স্ত্রীরা প্রতিদিন যে মানসিক চাপে থাকেন, তাকে আমরা ‘ইমোশনাল লেবার’ বলি—এটা শুধু কাজের চাপ নয়, একধরনের নিরব মানসিক সংগ্রাম। তারা একা হাতে সামলান সংসার, সন্তানের মানসিক চাহিদা, পরিবারের দায়-দায়িত্ব এবং সমাজের নানা প্রত্যাশা। এই দীর্ঘস্থায়ী চাপের ফলে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে তৈরি হয় মানসিক ক্লান্তি, উদ্বেগ, বিষণ্নতা এমনকি শারীরিক অসুস্থতাও। কিন্তু দুঃখজনক হলো, তাদের এই মানসিক শ্রম ও আত্মত্যাগের কোনো স্বীকৃতি নেই সমাজে—বরং তারা আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। আমাদের উচিত এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা এবং তাদের জন্য মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থাপক ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত টিআইপি হিরো অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত আল-আমিন নয়ন বলেন-প্রবাসীরা বিদেশে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য। কিন্তু তার চেয়েও কঠিন সংগ্রাম চলে তাদের স্ত্রীর জীবনে। দেশে একা থেকে সন্তান বড় করা, সংসার চালানো, সমাজের নানা চাপে সামলানো—সব কিছুই তাদের কাঁধে। যারা এই নারীদের পাশে থেকে দেখেন, তারা জানেন নারীরা আসলেই সবকিছু করতে পারেন। তারা একা থাকলেও ভেঙে না পড়ে, লড়ে যায় অবিরত। তাই প্রবাসীর স্ত্রীদের জীবন সংগ্রাম আমাদের সবাইকে সম্মান জানানো উচিত।
অনেক নারীই চান না তাদের সন্তান বিদেশে গিয়ে আবার এমন এক ফাঁকা সংসার গড়ুক। তবুও বাস্তবতা তাদেরও বাধ্য করে স্বামীকে বিদেশ পাঠাতে। কারণ দেশে জীবিকা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে উঠেছে।
পরিবার টিকিয়ে রাখার এই নীরব সংগ্রামে নারীরা প্রতিদিন জয়ী হন, যদিও কেউ তাদের জয় দেখে না। তারা ভাঙেন না, বরং প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত লড়েই যান—একাই দুজনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে।
প্রবাসীর সন্তানদের জীবনে বাবার জায়গাটা ফাঁকা। স্কুলে অভিভাবক সমাবেশে শুধু মা যায়, খেলাধুলায় কেউ সঙ্গ দেয় না। সন্তানেরা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয় বাবাহীন এক জীবন নিয়ে। তারা ভাবে, আমার বাবাও ফোনে থাকে—এটাই তাদের বাস্তবতা।