তীব্র গরমে অস্থির হয়ে একটু শান্তির পরশ পেতে শীতল পাটির বিকল্প নেই। এ কারনে শীতল পাটির বিক্রি বর্তমান মৌসুমে যেমন বেড়েছে, তেমনই পাটি করদের ব্যস্ততাও বেড়েছে। জামালগঞ্জের শীতল পাটির কদর রয়েছে সারা দেশে।
তাই এই উপজেলার ৭টি গ্রামে ৮০ বছরের বৃদ্ধ থেকে ৯-১০ বছরের শিশুরা ও নিপুন কারুকাজে ব্যস্থ সময় পাড় করছে। পাটি শিল্পীদের সাথে কথা বলে জানাযায় জামালগঞ্জের শীতল পাটি প্রায় ২শত বছর ধরে দেশে ব্যাপক সমাদৃত। এখানকার চিকন বেতের শীতল পাটি চাহিদা প্রচুর। এই অঞ্চলে অতিথিদের শীতল পাটি বিছিয়ে নিজেদের আভিজ্যাত্যকে ফুটিয়ে তুলছে অনেকে। পাটি শিল্প বাংলাদেশের লোকাচারে জীবন ঘনিষ্ট ও ঐতিহ্যের অলৌকিক উপাদান। গরমে রৌদ্রের তাপে এই পাটি গরম না হওয়ার কারনে এই পাটিকে শীতল পাটি বলা হয়। মোর্তা নামের এক ধরনের উদ্ভিদের কান্ড থেকে বেতী তৈরী করা হয়। পাকনা মোর্তা গাছ কেটে পানিতে ভিজিয়ে তার পর বেতী তোলা হয়। এর পর ভাতের মাড় ও পানি দিয়ে জাল দেওয়া হয়। যার ফলে বেতী হয়ে উঠে মসৃন ও সাদাতে। বের্তী উপরের খোলস থেকে শীতল পাটি তৈরী করা হয়। এবং পরের অংশ সাধারন পাটি তৈরী করা হয়।
বর্তমানে জামালগঞ্জ উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের ৭টি গ্রামের প্রায় আড়াইশত পরিবার এ শিল্পের সাথে জড়িত। জামালগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের কদমতলী, সোনাপুর, দূর্গাপুর, চানপুরগ্রামে রয়েছে প্রায় ২শত পরিবার। ভীমখালী ইউনিয়নের কালিপুর এবং বেহেলী ইউনিয়নে বদরপুর ইনাতনগর গ্রামেপ্রায় ৫০টি পরিবার। এরা সবাই পাটি বুনে জীবিকা নির্বাহ করে। পুরাতন ঐতিহ্যের কারুকাজে গড়া শীতল পাটির জন্য এসবগ্রাম গুলাকে পাটি শিল্পীর গ্রামবলা হয়। সম্প্রতি শীতল পাটির গ্রাম হিসাবে সমাধৃত কদমতলী গ্রামকে পরিবেশবাদী গ্রাম হিসাবে উপজেলায় স্বীকৃতি লাভ করে। এসব গ্রামগুলাতে শীতল পাটি, নামাজেরপাটি ও আসন পাটি নামে তিন ধরনেরপাটি তৈরী করা হয়। দুই ধরনের পদ্ধতিতে শিল্পীরা পাটি বুনন করেন। গ্রামে পাটির জমিনে জো-তুলে তাতে রঙ্গিন বেতী দিয়েন কশা করা হয়। আবার পাটির জমিন তৈরী হলে তার চতুর্দিকে অন্য রংয়ের বেতী দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়।
পরিবারিক ও উত্তরাধীকার সূত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাটি শিল্পীরা পাটি তৈরী করছে। নারী পাটি শিল্পীদের সুনিপুল হাতের ছোয়ায় পাটি তৈরীর কদর রয়েছে সর্ব এই। একটি পাটি বুনতে ৩জনের ৩দিন সময় লাগে। যা বিক্রি করা হয় ৮শত থেকে ১ হাজার টাকা। পাইকাররা পাটি কিনে নিয়ে ১শত থেকে ৩শত টাকা লাভকরে বাজারে পাটি বিক্রি করেন।
বিভিন্ন এলাকা থেকে মোর্তা কিনার জন্য প্রচুর মুলধন প্রয়োজন হয়। এই জন্য শিল্পীরা বিভিন্ন এনজিও এবং মহাজনের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়। শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যকে পাটি শিল্পীরা ধরে রাখলেও অর্থনৈতিক ভাবে দিন দিন জীবন যাত্রারমান উন্নত হচ্ছেনা। ব্যাংক ঋনের ব্যবস্থা না থাকায় এবং নিজ এলাকায় মোর্তা চাষনা থাকার কারনে শিল্পীরা বিভিন্ন দাদন ব্যবসায়ী ও সুদখোর মহাজনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন।
সোনাপুর মহিলা কুটির শিল্পী সমিতির সভাপতি মুক্তা রানী নন্দী ও সাধারন সম্পাদক হেপীরানী কর বলেন আমাদের শীতল পাটি দেশের বিভিন্ন মেলায় কিংবা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের অন্য কোন উপার্জন নেই। শুধু শীতল পাটি বিক্রি করেই সংসারের ও ছেলে মেয়েদের লেখা-পড়া খরচ চালাই। শীত ও বর্ষায় আর্থিক সংকটে পড়তে হয়। সরকার বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋন দিলে এক সাথে বিভিন্ন এলাকা থেকে মোর্তা কিনে এনে শীতল পাটি তৈরী করা যেত।
শিক্ষার্থী তৃপ্তী কর, মনিকা রানী কর জানায় তাদের পরিবারের সবাই পাটি বুনতে পারে। মা বাবাকে সহযোগীতা করার জন্য পড়ালেখার পাশাপাশী তারা ও পাটি তৈরী করেন। যার কারনে বাবা মায়েরা ও খুশী।
দূর্গাপুর ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মহিলা সমিতির সভাপতি সবিতা রানী কর বলেন, সরকার এই উপজেলার ৭টি গ্রামের পাটি শিল্পীদের সরকারী যে কোন ব্যাংক থেকে বাৎসরিক কিস্তিতে ঋন দেওয়ার ব্যবস্থা করলে এবং আমাদের গ্রামের পাশে প্রচুর সরকারী পতিতজমি রয়েছে। সেসব জমিতে মোর্তা করার জন্য বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করলে আমরা উপকৃত হতাম। নতুবা এই পাটি শিল্পী এক সময় বিলিন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখনই প্রায় শতাধিক পরিবার অন্য পেশায় চলে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্ম কর্তা মুশফিকীননূর জানান, সরকারি ভাবে সমাজ সেবা কার্যালয় থেকে কিছু মহিলাকে ১৮ হাজার টাকা করে স্বল্প সুদে ঋন দেওয়া হয়েছে। আমরা সরকারের অতিদরিদ্র কর্মসৃজন কর্মসুচীর মাধ্যমে পাটি শিল্পীদের কাজের আওতায় আবার চেষ্টা করতো।