জামালগঞ্জ উপজেলার সেরমস্তপুর পাখীর ডাকে ভোরেই ঘুম ভাংগে গ্রামবাসীর। গ্রামটি “পাখী গ্রাম” হিসাবেও পরিচিত। পাখীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গার পর গ্রামবাসী হয়ে পরেন কর্মব্যস্ত। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে কাঠের নৌকা তৈরী ও বেচা কেনার ধুম পরে যায় এই গ্রামটিতে। বংশ পরস্পরায় শত বছরের নৌকা তৈরীর ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন এই গ্রামের কারিগররা। পাখীর কিচিরমিচিরের পাশাপাশী নৌকার গ্রাম হিসাবেও পরিচিত লাভ করেছে সেরমস্তপুর।
এই গ্রামটি জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজার ইউনিয়নের প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠা একটি গ্রাম। তবে এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গ্রামের নৌকা পরিবারদের সাথে কথা বলে জানা যায় বাপ দাদার হাত ধরে বংশ পরস্পরায় শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তারা। বহু বছরের পুরানো গাছ গাছালী পাখীর কলকাকলী ও নৌকার গ্রাম হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে সেরমস্তপুর গ্রাম। এখানে যেমন নৌকা তৈরী হয় আবার পাইকারী ও খুচরা দরে বিক্রিও হয়। প্রতিদিনই গ্রামটিতে নৌকা বেচা-কেনা হয়। আর যে কয়টা থাকে তা সাপ্তাহিক হাট সাচনা বাজারে বিক্রি হয়।
প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৩০টি আলং (নৌকা তৈরীর কারখানায়) শতাধিক নৌকা বিক্রি হয়। প্রতিটি নৌকা ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বিক্রয় করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন নকশাজনিত কিংবা ইঞ্জিন চালিত নৌকা ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রয় করা হয়।
বিভিন্ন উপজেলা থেকে পাইকাররা আসেন নৌকা কিনতে। সেরমস্তপুর গ্রামের নৌকা কারীগর সায়েদুল মিয়া বলেন বাপ দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখাতে এ’পেশা বেছে নিয়েছি। এই গ্রামের ৩০টি আলং এ প্রায় ৫০টি পরিবার নৌকা তৈরীর সাথে জড়িত। এপেশাকে ঘিরে প্রায় শতাধিক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। জনপ্রতি কারিগরকে ৬শত থেকে ৭শত টাকা দিতে হয়। ৩ জন কারীগর সপ্তাহে ৬ থেকে ৭টি নৌকা তৈরী করতে পারে। প্রতিটি নৌকায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। বিক্রি করা হয় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা। প্রতি মাসে খরচ বাদে ৫০/৬০ হাজার টাকা উপার্জন হয়।
একই গ্রামের কারিগর দেলোয়ার হোসেন, দিলসাদ, সিয়াম জানায় প্রতি সোমবার সাচনা বাজারে নৌকার হাট বসে। আমাদের দাদা, বাবারা এই পেশায় ছিল আমরা প্রায় ২০ বছর যাবত এই পেশায় আছি। নৌকা তৈরীতে বেশীর ভাগ চাম্বল, মেহগনি, আম কাট ব্যবহার করা হয়। তবে এবার বর্ষায় পানি কম হওয়ায় অন্য বছরের তুলনায় বেচাকেনা অনেকটা কম। আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বেচাকেনা বেশী হয়। তবে বর্ষায় ছয় মাসই নৌকার চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন জেলেরা হাওরে মাছ ধরতে, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাতায়াতে নৌকা ব্যবহার করে থাকেন। আব্দুর রবের ছেলে ৩য় শ্রেনীর শিক্ষার্থী মোজাম্মিল এবং কামাল হোসেনর ছেলে ২য় শ্রেণীর শিক্ষার্থী আরিয়ান জানায় পড়া লেখার ফাকে ফাকে নৌকার পাতাম লাগানোর কাজ করি। ঘন্টায় ১ শত থেকে দেড়শত পাতাম লোহা লাগাতে পারি। ৭ বছর বয়সী রোহান জানান আমি ও আমার পিতার সাথে নৌকা তৈরীতে কাজে সহযোগীতা করি। স্কুল থেকে এসে আবার স্কুল বন্ধ থাকলে নৌকায় পাতাম লোহা লাগাই।
নৌকার কারীগর প্রতিবন্ধী হাফিজ জামাল (৩০) জানান আমি ৫ বছর বয়স থেকে নৌকা তৈরী করে আসছি। আমার বাবাও এই কাজ করতেন। দুই পা না থাকায় হাত দিয়ে সব কাজ করতে হয়। ২জন কারীগর মিলে সপ্তাহে ৩টা নৌকা তৈরী করা যায়। এতে মাসে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় হয়। সুনামগঞ্জ সহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা পাইকাররা নৌকা কিনে নিয়ে বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করেন। নৌকা ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, সেরমস্তপুর গ্রাম থেকে প্রতি সপ্তাহে ১০ থেকে ১৫টি নৌকা কিনে বিভিন্ন হাটে বিক্রি করি। প্রতিটি নৌকায় ৭শত থেকে ১হাজার টাকা লাভ হয়। ১৫ বছর ধরে নৌকা কেনা বেচা করি। তিনি জানান গত বছরের চেয়ে নৌকার দাম অনেক বেশী। যে নৌকা গত বছর ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় কিনতে পারতাম সে নৌকা এবার ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে।
জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুশফিকীন নূর বলেন এই সেরমস্তপুর গ্রামটি নৌকা তৈরীর গ্রাম হিসাবে পরিচিত। এই গ্রামের প্রায় শতাধীক পরিবার নৌকা তৈরী করে লাভবান হচ্ছেন। এই গ্রামের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল ধরনের সহযোগীতা করা হবে।