মাটিতে বসে লিখি, পিঠে ব্যথা হয়, মা কয় বই পড়লে ভালো চাকরি পাওয়া যায়। আমি ম্যাডাম হতে চাই… কিন্তু স্কুলে গেলে বসার জায়গা পাই না। মাটিতে বসি। কাঁদতে মন চায়, তাও কাঁদি না। তাও স্কুলে আসি।
চোখে জল, কণ্ঠে স্বপ্ন নিয়ে কথাগুলো বলছিল সিলেটের বুরজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী হৃশিতা নায়েক। তার মা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চা বাগানে খেটে চলেন—বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে। সেই শ্রমের বিনিময়ে যা জোটে, তা হাতে নিয়ে হৃশিতা হাঁটে স্কুলের পথে—ভবিষ্যতের আশায়, শিক্ষার আলোয় জীবন গড়ার প্রত্যাশায়।
পঞ্চম শ্রেণির আরেক ছাত্রী হুসনা আক্তার বলেন- “আমি অনেক দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে আসি। কিন্তু এখানে এসে যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাটিতে বসে থাকতে হয়, তখন শরীরটাও ক্লান্ত হয়ে পড়ে, পড়াশোনাতেও মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে যায়।”
শুধু হৃশিতা বা হুসনা নয় বুরজান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এ রকম আরো অনেক ছাত্র ছাত্রী স্কুলে গিয়েও ঠাঁই হয় না একটি বেঞ্চেও। নেই বসার জন্য প্রয়োজনীয় বেঞ্চ-ডেস্ক।
কোমলমতি শিশুরা মাটিতে বসেই পাঠ নেয়। বর্ষার দিনে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়ে পানি। শিশুরা কাদা আর ভেজা খাতার সঙ্গে সংগ্রাম করে, তবু কোনো অভিযোগ নেই কারো মুখে।
এ বিষয়ে হৃশিতার মা বলেন -সারাদিন বাগানে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে খেটে খাই, ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে রাতে ঘরে ফিরি—সবই করি মেয়ের মুখে একটুখানি হাসি আর ভবিষ্যতের আশায়। চাই মেয়েটা মানুষ হোক, লেখাপড়া শিখে নিজের একটা জীবন গড়ে তুলুক। কিন্তু স্কুলে গিয়ে দেখি, সে মাটিতে বসে ক্লাস করে। বই খাতা মেলে পায়ের ওপর রেখে লেখে—এ দৃশ্য দেখে বুকটা হাহাকার করে উঠে।
পিঠ আর ঘাড়ের ব্যথায় রাতে ঘুমাতে পারে না, সকালে সেই ব্যথা নিয়েই আবার স্কুলে যায়। আমি তো চা-পাতা তুলেই দিন পার করি, চিকিৎসাও করাতে পারি না ঠিকমতো। প্রতিদিন ভয় লাগে—এইভাবে চলতে থাকলে মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়বে।
আমার সাধ্য নেই ভালো কিছু দিতে, কিন্তু চাই অন্তত একটা বেঞ্চ-টেবিলে বসে যেন সে স্বাভাবিকভাবে পড়তে পারে। স্কুলে গিয়ে যখন দেখি, মেয়েটা গুটিশুটি মেরে মাটিতে বসে, তখন নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়।
এ বিষয়ে বুরজান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দ্বিপালী রানী নায়েক বলেন- তাদের মতো ছাত্রছাত্রীরা সত্যিই অসাধারণ। ওদের চোখে স্বপ্ন আছে, মনে আছে জেদ। শুধু একটু সহানুভূতি আর সহযোগিতা পেলে এরা আকাশ ছুঁতে পারে। কিন্তু দিনের পর দিন মাটিতে বসে লেখা—পিঠে ব্যথা, হাতে ব্যথা—এই কষ্টগুলো কেউ দেখে না, কেউ বোঝে না। এই অবহেলাতেই হারিয়ে যায় অনেক প্রতিভা।
এ বিষয়ে মদন মোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ লে. কর্নেল (অব.) এম আতাউর রহমান পীর বলেন-
শিশুর মনোযোগ, স্বাস্থ্য ও আত্মসম্মান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যখন তারা মৌলিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। সিলেটের বুরজান চা বাগানের শিশুরা আজও মাটিতে বসে ছেঁড়া চট বা খালি মেঝেতে পড়ালেখা করছে—এটি সত্যিই দুঃখজনক। একটি বেঞ্চের অভাব তাদের সম্মানজনক শিক্ষার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই অবস্থা বদলানো সম্ভব—যদি আমরা সবাই একসাথে এগিয়ে আসি। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, সমাজসেবী ও প্রবাসীদের আন্তরিক সহযোগিতায় পরিবর্তন সম্ভব।আসুন, আমরা সবাই মিলে গড়ে তুলি একটি মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষার পরিবেশ। এই দায়িত্ব আমাদের সবার।
এই বিষয়ে প্রত্যাশা সমাজ কল্যাণ যুব সংঘের সভাপতি সাইদুল ইসলাম সোহেল বলেন - আমরা দীর্ঘদিন ধরে চা বাগান এলাকাগুলোতে শিক্ষার হার বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছি। বিশেষ করে চা শ্রমিক পরিবারগুলোকে সচেতন করছি, যেন তারা তাদের সন্তানদের নিয়মিত স্কুলে পাঠান। অনেক মা–বাবাই এখন বিষয়টি বুঝতে শুরু করেছেন, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভাবছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, স্কুলে বাচ্চাদের জন্য একটি সুষ্ঠু ও সহনীয় পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না।
ছাত্রসংখ্যা অনুযায়ী স্কুলের জায়গা খুবই অপ্রতুল। অনেক স্কুলে নেই পর্যাপ্ত কক্ষ, নেই পর্যাপ্ত ডেস্ক–বেঞ্চ। শিশুরা বাধ্য হয়ে মাটিতে বসে ক্লাস করছে, যা শারীরিকভাবে কষ্টদায়ক এবং দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষায় আগ্রহ হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের একার প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। আমি চাই, সমাজের অন্যান্য সংগঠন, সমাজকর্মী ও হৃদয়বান মানুষরা এগিয়ে আসুন। একসাথে কাজ করলে আমরা নিশ্চয়ই বাচ্চাদের জন্য একটি সুন্দর, নিরাপদ ও সম্মানজনক শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে পারব। এটাই হোক আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার।
এ বিষয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা IDEA-এর ECETG প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী সুদীপ্ত চৌধুরী বলেন — বিদ্যালয়টিতে জায়গার খুবই অভাব। তাই আপাতত মাদুর বিছিয়ে শিক্ষার্থীদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে একসঙ্গে অনেকেই বসতে পারে। তবে সাইডের যে ফাঁকা জায়গা রয়েছে, সেখানে Childaid Network-এর অর্থায়নে আইডিয়ার পক্ষ থেকে নতুন একটি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণের পরিকল্পনা চলছে। কাজ সম্পন্ন হলে সেখানে স্থায়ীভাবে বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।
এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)-এর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন — বুরজান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাটিতে বসে লেখাপড়া করে—বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এই প্রতিবেদকের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে তিনি তার কষ্টের কথা জানিয়ে এ সমস্যা সমাধানে বাগান কর্তৃপক্ষকের আশুদৃষ্টি কামনা করেন।
শিক্ষা হলো প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকার, আর সেই শিক্ষা গ্রহণের পরিবেশ যদি সুষ্ঠ না থাকে তাহলে তা অবশ্যই আমাদের সবাইকে ভাবনায় ফেলবে। আমরা বিশ্বাস করি চাবাগান কর্তৃপক্ষের ছোট্ট একটি উদ্যোগেই এর স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
ওরা শুধু চেয়ে থাকে—একটি মানবিক পরিবেশের দিকে, একটি ভালো জীবনের আশায়। ওদের স্বপ্ন, ওদের চোখের জল যেন আজ সমাজের চোখে পড়ে, যেন ওদের বসার জন্য অন্তত একটি বেঞ্চের ব্যবস্থা হয়।