ভালো ভবিষ্যতের স্বপ্নে চোখ মেলে একদিন বাড়ি ছেড়েছিলেন তারা। পরিবারের শেষ সম্বল, ঋণ আর দালালের মিষ্টি কথায় ভর করে পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে। কিন্তু লিবিয়ায় পৌঁছে বাস্তবতা হয়েছে ভয়াবহ—সেই স্বপ্ন পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। নয় মাস ধরে বন্দি থেকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা। শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের সহায়তায় ও আন্তর্জাতিক সহায়তায় সেই মৃত্যুপুরী থেকে মুক্ত হয়ে ফিরছেন নিজের দেশে।
ঝিনাইদহের মতিউর রহমান সাগর ও কুষ্টিয়ার তানজির শেখ—এই দুই তরুণ বাংলাদেশের সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা। বিদেশে গিয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো ছিল তাদের লক্ষ্য। ২০২৩ সালে গ্রামের একাধিক দালালের মিথ্যা আশ্বাসে তারা পরিবার থেকে ৪ লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বলা হয়েছিল, সেখানে পৌঁছেই ভালো কোম্পানিতে চাকরি পাবেন। কিন্তু বাস্তবে কোনো চাকরি তো দূরের কথা, পা রাখার কিছুদিনের মধ্যেই তারা এক মানব পাচার চক্রের খপ্পরে পড়েন।
পাচারকারীরা তাদের ইতালিতে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে বিক্রি করে দেয় ভয়ংকর এক মাফিয়া চক্রের হাতে। ওই চক্র তাদের প্রায় ৮০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে অন্ধকার একটি কক্ষে বন্দি করে রাখে। সেখানেই শুরু হয় পৈশাচিক নির্যাতন—দিনরাত লোহার রড, লাঠি, বৈদ্যুতিক শক দিয়ে চলে অবর্ণনীয় নিপীড়ন। খাবার তো দূরের কথা, পানি পর্যন্ত না দিয়ে দিনের পর দিন ফেলে রাখা হতো। অনেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, মানসিক ভারসাম্য হারান।
একপর্যায়ে নির্যাতনে মৃতপ্রায় হয়ে পড়লে সাগর ও তানজিরকে ফেলে রেখে চলে যায় চক্রটি। তাদের মনে হয়েছিল, এরা আর বাঁচবে না। কিন্তু বেঁচে ছিলেন—বেঁচে ছিলেন আশার আলোয়। পরে ত্রিপোলির এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন তারা। সেখান থেকেই শুরু হয় দেশে ফেরার লড়াই।
পরিবারের আবেদনে সাড়া দিয়ে ব্র্যাক বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে আসে। তাদের সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ‘ট্রাফিকিং ইন পারসনস (TIP)’ অফিস, আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশন (IJM)’ এবং ‘আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM)’ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করে। তাদের উদ্যোগে আইওএমের লিবিয়া কার্যালয় ওই দুই তরুণকে উদ্ধার করে একটি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে (সেইফ হোম) রাখে।
দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া, পরিচয় যাচাই, কাগজপত্র ও ভিসার আনুষ্ঠানিকতা শেষে অবশেষে দেশে ফেরার অনুমতি মিলেছে।
গত (৯ জুলাই) সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে বুরাক এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে (ফ্লাইট নম্বর: UZ222) তারা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
শুধু সাগর ও তানজিরই নয়—সিলেটের বহু তরুণও এমনই প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফিরে আজ রাস্তায় রোজগারের জন্য হাত পাততে বাধ্য হচ্ছেন।"
এই ফিরে আসা কেবল একটি প্রবাসফেরত ঘটনার গল্প নয়, এটি এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত—যেখানে ভুল স্বপ্ন দেখানো এক তরুণ জীবনের চরম দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়। একই সঙ্গে এটি এক অনুপ্রেরণাও—যেখানে পরিবার, সংগঠন ও রাষ্ট্র মিলে একটি জীবনকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
এ বিষয়ে সিলেট নগরের আম্বরখানা বড় বাজার এলাকার বাসিন্দা কাতারপ্রবাসী জুয়েল আহমদ জানান - আমি গত মাসেই অনেক কষ্টে দেশে ফিরেছি। বিদেশে গিয়েছিলাম স্বপ্ন নিয়ে—পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়তে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আজ ভেঙে চুরমার। আমার পরিবার আমার ওপরই নির্ভরশীল। তাই বাধ্য হয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম। অথচ আজ আমি খালি হাতে, সব হারিয়ে, শুধু প্রাণটা নিয়ে দেশে ফিরেছি।”
সিলেটের গোয়াইপাড়া এলাকার বাসিন্দা প্রবাসী শাহিন আহমদের স্ত্রী সাবিনা আক্তার বলেন,
“আমার স্বামী শাহিন আহমদ তিন বছর ধরে কাতারে রয়েছেন। শুরুর দিকে তিনি কিছু টাকা পাঠাতেন, কিন্তু এখন আর সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, তাঁর আকামার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি কোনো বৈধ কাজ করতে পারছেন না। এমনকি ঠিকমতো ঘর থেকেও বের হতে পারছেন না। তিনি নিজেই এখন অসহায় অবস্থায় দিন পার করছেন।
সৌদি আরব থেকে প্রবাসী মোসাহিদ আহমদ জানান - দালালের মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস করে আজ আমি চরম দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছি। তারা বলেছিল, সৌদিতে দর্জির কাজ দিবে—কিন্তু বাস্তবে এসে দেখি, কাজ তো দূরের কথা, নানা রকম খাটুনি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছি। ‘আকামা’ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে, ফলে বাইরে বেরোতে পারি না, কাজও করতে পারি না। অসুস্থ হলেও চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই। এই অচল অবস্থা থেকে মুক্তির কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। একরকম বন্দী হয়ে আছি বিদেশের মাটিতে, দেশে ফিরতেও পারছি না।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মদন মোহন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ লে. কর্নেল (অব.) এম আতাউর রহমান পীর বলেন - প্রকাশিত প্রতিবেদনটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—কীভাবে একটি সংঘবদ্ধ দালালচক্র প্রান্তিক তরুণদের জীবন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানব পাচার এখন আর কেবল স্থানীয় কোনো সমস্যা নয়; এটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রে পরিণত হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহজেই প্রলোভনের ফাঁদে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে মিডিয়ার দায়িত্ব কেবল তথ্য পরিবেশন নয়, বরং এসব অপরাধচক্রের নেটওয়ার্ক উন্মোচন করাও জরুরি। কারণ, জনসচেতনতা ছাড়া এই ভয়াবহতা রোধ সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসীদের কল্যাণে গ্লোবাল জালালাবাদ এসোসিয়েশন সিলেট ইউনিট কাজ করে আসছে, ভবিষ্যতেও আমরা এ ধরনের কল্যাণমূলক উদ্যোগের সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার করছি।
এ বিষয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ম্যানেজার আল আমিন নয়ন বলেন-সম্প্রতি মানব পাচারের শিকার হয়ে লিবিয়ায় আটকে পড়া তিন বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ট্রাফিকিং-ইন-পারসন্স (টিআইপি) হিরো নেটওয়ার্কের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। এর আগেও গত ২৫ জুন একইভাবে আরও দুজন বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।”
তিনি আরও বলেন, “বিদেশফেরত অভিবাসীদের জন্য জরুরি সহায়তা দিতে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টার গত আট বছর ধরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। সিভিল এভিয়েশন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক ও এপিবিএনের সহযোগিতায় এ সময়ের মধ্যে ৩৭ হাজারের বেশি অভিবাসীকে চিকিৎসা, খাবার, যাতায়াত ও আইনি পরামর্শসহ বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
তাদের ফিরে আসা আমাদের সমাজের জন্যও একটি সতর্কবার্তা। এখনও দেশের বহু তরুণ প্রতিদিন দালালের খপ্পরে পড়ে লিবিয়া, দুবাই, মাল্টা, তিউনিশিয়া কিংবা ইতালির পথে পা বাড়াচ্ছেন। কেউ ফিরে আসেন লাশ হয়ে, কেউ হারিয়ে যান চিরতরে।
এই ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানব পাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা, আইনি ব্যবস্থা, অভিবাসন নিরাপত্তা এবং দালাল চক্রের শেকড় তুলে ফেলা ছাড়া আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা সম্ভব নয়।