মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫
মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

চা বাগানে শিক্ষা ব্যাবস্থা ২

সিলেটের চা বাগান গুলোতে নেই কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, প্রাথমিকেই ‘শেষ স্টেশন’

আমার মেয়ে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত  পড়েছিল, তারপর আর পড়তে পারেনি…।কারণ আমাদের বাগানে কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই আর যেটা আছে সেটা অনেক দুরে। সেখানে যাওয়া আসা একটা মেয়ের জন্য অনেক কষ্টের। বৃষ্টির দিনে মেয়েটি স্কুলে যেতে পারত না। রাস্তা কাদায় ভরে যেত ধীরে ধীরে পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে সে। এই যে কষ্ট, তা শুধু একটি মা হার মানার গল্প নয়—এটা চা বাগানের মেয়েদের জন্য শিক্ষার পথ রুদ্ধ হওয়ার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। জৈন্তাপুর বালিঙ্গা চা বাগানের শ্রমিক বিনতা বাউরীর কষ্ট ভরা কন্ঠে এই কথাগুলো বলছিলেন।


শুধু বিনতা নয় এই বাস্তবতা সিলেটের শতাধিক চা বাগানে প্রতিদিনই ঘুরে ফিরে আসে। যেখানে চা শ্রমিকদের কষ্টার্জিত জীবনে মেয়েদের পড়াশোনা বিলাসিতা নয়, এক অসম্ভব স্বপ্ন। আর এই স্বপ্নভঙ্গ শুধু ব্যক্তিগত নয়—সমাজ ও রাষ্ট্রেরও এক বড় ব্যর্থতা।

সিলেটের বুরজান চা বাগানের চা শ্রমিক পরিবারের সন্তান কার্তিক নায়েক এ বছর প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তাকে প্রতিদিন প্রায় তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। কারণ, তাদের এলাকায় কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই।

কার্তিক জানায়-আমি এবার প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা দিয়েছি। আমার বাবা গকুল নায়েক একজন চা শ্রমিক। তিনি অনেক কষ্ট করে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু স্কুলে যাওয়া-আসা খুব কষ্টকর, প্রতিদিনই লম্বা পথ হেঁটে যেতে হয়।"

দেশের এক কোণে, যেখানে ছড়িয়ে আছে অপার সবুজ চা-বাগান, সেখানে শিক্ষার আলো আজও পৌঁছায়নি প্রত্যেক শিশুর হৃদয়ে। সিলেট জেলার প্রায় ২৩ টিরও বেশি চা-বাগানে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্তু মাধ্যমিক স্তরের কোনো বিদ্যালয় নেই। ফলে হাজার হাজার শিশু, বিশেষ করে মেয়েরা, পড়াশোনা শেষ করার আগেই থেমে যায় স্বপ্ন গড়ার রাস্তা।

চা বাগানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কিছুটা হলেও আছে। তবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অভাবে পড়ুয়াদের অনেককে বাড়ি থেকে ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে স্কুলে যেতে হয়। ছোট বয়সী শিশুর পক্ষে সে দুরত্ব হাঁটা প্রায় অসম্ভব। বিশেষ করে বৃষ্টির সময়, যানবাহনের অভাব এবং নিরাপত্তার কারণেও অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দেয়।

এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে চা বাগানের যুব সংগঠক সাইদুল ইসলাম সোহেল বলেন - একদিকে মজুরি মাত্র ১৭৮ টাকা—এই সামান্য আয় দিয়ে পরিবার চালানোই যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ চালানো আরও কঠিন। অনেক কষ্টে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়লেও মাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়ে বাধা এসে পড়ে। কারণ বাগান থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৪-৫ কিলোমিটার দূরে। পায়ে হেঁটে প্রতিদিন সেখানে যাতায়াত করা ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর, আর গাড়িতে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য আমাদের নেই। যদি সরকারি উদ্যোগে দুই-তিনটি বাগানের মাঝামাঝি কোথাও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হতো, তাহলে চা শ্রমিকদের সন্তানরা বাধাহীনভাবে মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করতে পারত।

এ বিষয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা অভিজিৎ কুমার পাল বলেন -চা বাগান ভেতর কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত দুঃখজনক। বিষয়টি আমরা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি এবং ইতোমধ্যেই উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আশা করছি, অচিরেই এই অবহেলিত অঞ্চলের শিক্ষার অগ্রযাত্রায় কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ আসবে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হয় এবং চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর সন্তানরাও মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ পায়।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন - চা বাগান এলাকায় যাতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়, সে বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবো। চা শ্রমিক সম্প্রদায়ের সন্তানরা যাতে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে লেখাপড়া থেকে ছিটকে না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

 মদন মোহন কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল লে. কর্নেল (অব.) এম আতাউর রহমান পীর বলেন -  প্রাথমিক শিক্ষা তো শুরু, কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় শিক্ষাজীবন আটকে যাচ্ছে। শিশুদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা ভাঙলে সমাজ ও দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয়। তিনি বলেন - মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বাল্যবিবাহ। স্থানীয় একটি এনজিও’র জরিপে দেখা গেছে, চা বাগানে মেয়েদের প্রায় ৫০ শতাংশই ক্লাস ফাইভের পর পড়াশোনা বন্ধ করে দেয় এবং অনেকের বিয়ে হয়ে যায় কম বয়সেই।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন—চা বাগানে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্য উচ্চশিক্ষা এখনো রূপকথার মতো—যেন সোনার হরিণ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোই তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ, গাইডলাইন বা সহায়ক পরিবেশের একেবারে অভাব রয়েছে। চা শ্রমিক পরিবারের শিশুরা স্কুলে যাওয়ার আগেই অনেক সময় পারিবারিক কাজে জড়িয়ে পড়ে—বিশেষ করে মেয়েরা। ফলে মাধ্যমিক পর্যায়ে পৌঁছানো তো দূরের কথা, প্রাথমিকের পরই অনেকের পড়াশোনার ইতি ঘটে।

সরকারি একটি নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদ নেওয়াজ বলেন-আমরা এখন বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছি। কিন্তু চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক সম্ভাবনাময়, মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদের শিক্ষাজীবন প্রাথমিকের গণ্ডিতেই থেমে যায়—শুধু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অভাবে। ফলে তারা অল্প বয়সেই শ্রমে জড়িয়ে পড়ে, স্বপ্ন গোঁধে না।

রাষ্ট্রের উচিত এই বঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষা অবকাঠামো গড়ে তোলা, যেন তারা উপযুক্ত সুযোগ পেয়ে সমাজের সম্পদে পরিণত হতে পারে। শিক্ষার আলো যদি তাদের দরজায় না পৌঁছায়, তাহলে পুরো জাতিই একটি বড় শক্তিকে হারিয়ে ফেলবে। এখনই সময়, পাহাড়-চা-বাগান অঞ্চলের শিশুদের জন্য কার্যকর ও টেকসই শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করার।

এই দেশে জন্ম নিয়েও তারা মৌলিক অধিকার—শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিক্ষা যেন তাদের জন্য কোনো অগ্রাধিকারই না। সরকারিভাবে কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়, আর বাস্তবায়নেও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। প্রয়োজন বাগানের ভিতরেই মানসম্পন্ন বিদ্যালয়, মেধাবৃত্তি, নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সহায়তা এবং সচেতনতা তৈরি—না হলে এই শিশুরা বৈষম্যের একটা বৃত্তেই বন্দি থেকে যাবে।”

এ বিষয়ে ৩নং খাদিমনগর ইউনিয়নের মেম্বর আতাউর রহমান শামিম বলেন - বেশিরভাগ চা বাগানে এখনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। প্রাথমিকের পর শিক্ষার্থীদের থেমে যেতে হয়, কারণ দূরের স্কুলে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়।শত প্রতিভা থাকার পরও অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ।যেগুলো গড়ে উঠেছে, সেগুলোর রেজিস্ট্রেশনও সম্ভব হচ্ছে না—ভূমির অভাবে। চা শ্রমিকরা তো ভূমিহীন, সেখানে স্কুলের জন্য জমি যেন এক অধরা স্বপ্ন।

আমাদের পরিশ্রমের ফল হয় দেশের চায়ের কাপে কিন্তু আমাদের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ এতদিনও কেন হয়নি?অবশেষে, চা বাগানে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিবহনসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছেন এলাকার মানুষ। তারা চান, যেন এইসব শিশুরাও স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন পূরণ করে—অবাধ শিক্ষার আলোয় তাদের জীবন আলোকিত হয়।

এই সম্পর্কিত আরো