বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল জাফলং। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায়, ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই অপূর্ব স্থানটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। সেই দৃশ্য অসাধারণ ও মনোমুগ্ধকর। এছাড়া ডাউকি নদীর উপর ঝুলন্ত সেতু দর্শনার্থীদের বাড়তি আকর্ষণ যোগ করে। তাই প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন একনজর দেখতে আসেন দেশ-বিদেশের হাজারো ভ্রমণ পিপাসু পর্যটক।
কিন্তু প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন পর্যটকরা। ভারতীয় বিভিন্ন প্রসাধনী সামগ্রীর নামে স্থানীয় বাজারে উৎপাদিত ভেজাল শ্যাম্পু, সাবান, বডি লোশন, ফেইস ওয়াশ ও বিভিন্ন ধরণের তেলসহ শতাধিক পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া খাদ্যসামগ্রী বিস্কুট, চকোলেট, আচার, চা-পাতাসহ নিম্নমানে ভেজাল পণ্যসামগ্রী বিক্রি করা হচ্ছে পর্যটকদের কাছে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে কথা কাটাকাটি ও হামলার শিকার হচ্ছেন পর্যটকরা। অপরাধের স্বর্গরাজ্য জাফলংয়ে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য চরমে পৌঁছেছে। প্রায় ৩৫০টির অধিক ভাসমান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন থেকে এ অঞ্চলে অবৈধভাবে চালু থাকলেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, পুলিশ সদস্য, সাংবাদিক নামধারী কিছু দুবৃত্তদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে একটি চাঁদাবাজচক্র। এসব ভাসমান দোকানের কারণে প্রতারিত হয়ে দিন দিন জাফলংবিমুখ হয়ে উঠছেন পর্যটকরা।
ভাসমান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বসানোর মূলহোতা কথিত বৃহত্তর জাফলং পর্যটন কেন্দ্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কুদ্দুছ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক সেলিম আহমদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক কাওছার এবং জাফলং পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হোসেন মিয়া ও আলমগীর মিয়া। তারা সরকারের খাস জমি লিজ এনেছেন দাবি করে এসব ভাসমান ব্যবসায়ীদের দোকান ভাড়া দিয়েছে। এই চাঁদাবাজ চক্র প্রতিদিন তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দোকান প্রতি ৫শ’ থেকে ১হাজার টাকা চাঁদা আদায় করছে।
জানা যায়, ভাসমান দোকান বসিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন অজুহাতে প্রকাশ্যে চলছে চাঁদাবাজি। বিজিবি ক্যাম্প থেকে জিরো পয়েন্টে যাওয়ার পুরো এলাকায় রয়েছে প্রায় ৩৫০টির অধিক অস্থায়ী দোকান। সরকারের খাস জমির ওপর এসব অস্থায়ী দোকান বসিয়ে রমরমা ব্যবসা চালানো হলেও সে দিকে প্রশাসনের কোনো খেয়াল নেই। বিজিবি ক্যাম্পের মূল সড়ক থেকে ভারতের ঝুলন্ত ব্রিজ সংলগ্ন জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত এলাকায় নামতে হয় এসব অবৈধ দোকানের পাশের সরু পথ ধরে। এসব অবৈধ দোকান থেকে প্রতিদিন আদায় করা হচ্ছে, গড়ে ৩ লক্ষ টাকার উপরে। প্রতিমাসে কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্যের পসরা বসিয়ে চাঁদা আদায় করছে পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতি ও বৃহত্তর জাফলং পর্যটন কেন্দ্র ব্যবসায়ী নামের সংগঠন।
গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলে শুধু বৈধভাবে অস্থায়ী লিজ প্রদান করে এসব ভাসমান ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করে বড় অংকের রাজস্ব আদায় করতে পারত। এবং ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজদের কবল থেকে নিরাপদে ব্যবসা করতে পারত।
গতকাল রবিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বিজিবির সংগ্রাম ক্যাম্পের নিচ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামার পথে দুপাশ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য দোকান। নিচে সমতল ভূমিতে রয়েছে কয়েকটি বিশাল মার্কেট। ওপরে শামিয়ানা দিয়ে তৈরি এসব অস্থায়ী দোকান নিয়ন্ত্রণ করে বৃহত্তর জাফলং পর্যটন কেন্দ্র ব্যবসায়ী সমিতি ও জাফলং পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতি।
দোকানীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে দোকান বসাতে প্রথমে চাঁদাবাজদের ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়।
গতকাল জাফলংয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে বিষয়টি টের পেয়ে বৃহত্তর জাফলং পর্যটন কেন্দ্র ব্যবসায়ী সমিতি ও জাফলং পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সটকে পড়েন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, বৃহত্তর জাফলং পর্যটন কেন্দ্র ব্যবসায়ী সমিতির লোকজন ভাসমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করছেন। কোনো ব্যবসাযী চাঁদা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে তাকে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করা হয়।
বৃহত্তর জাফলং পর্যটন কেন্দ্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি কুদ্দুছ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম আহমদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে পুবের হাওয়া’কে চাঁদা তোলার কথা স্বীকার করে বলেন, এটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও অবগত আছেন। এবং পুলিশ প্রশাসন ও সাংবাদিকরা তাদের সাথে জড়িত রয়েছেন।
সরকারের খাসজমির ওপর নির্মিত এসব দোকান থেকে প্রতি মাসে কোটি টাকার বেশি চাঁদা তোলা হলেও তার কোনো তথ্য নেই গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসনের কাছে। বছরের পর বছর এই খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা থাকলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী বলেন, এখানকার সকল দোকানপাটই অবৈধ। এই জমি সরকার কাউকে লিজ প্রদান করেনি। যারা ভাসমান দোকান বসিয়ে চাঁদা আদায় করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাফলংয়ের সৌন্দর্য রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন তৎপর।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জানান, এই সম্পর্কে আমি অবগত নই, খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।