সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলায় খাসিয়া সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অনুসরণ করে আসছে, যেখানে পারিবারিক সম্পত্তি মূলত নারীদের হাতে থাকে। এই ব্যবস্থায় সাধারণত পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন, যা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে সম্প্রতি এই ঐতিহ্যবাহী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সম্প্রদায়ের পুরুষদের একটি অংশ আওয়াজ তুলেছে এবং সম্পত্তির সমান অধিকারের দাবি জানিয়েছে। তাদের মতে, তারা এই প্রথায় বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ছেন। তাই তারা চান সম্পত্তির বণ্টনে লিঙ্গভিত্তিক সমতা নিশ্চিত করা হোক।
এ বিষয়ের সিলেটের খাসিয়া জনগোষ্ঠীর সাথে কথা বললে জৈন্তাপুরের খাসিয়া সেবা সংঘ নিজপাট এর সভাপতি সুরঞ্জিত রম্বাই বলেন - আমরা নারীদের অধিকার কেড়ে নিতে চাই না—বরং আমরা চাই আমাদেরকেও সমান সুযোগ দেওয়া হোক। যদি সমান সুযোগ সম্ভব না-ও হয়, তবুও অন্তত সম্পত্তির উপর কিছুটা অধিকার যেন আমাদেরও থাকে। কারণ, এখন আমরা আর আগের মতো পিছিয়ে নেই। আমাদের সন্তানরা শিক্ষিত হচ্ছে, অনেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশেও যেতে আগ্রহী। আধুনিক সমাজে যখন লিঙ্গ-সমতার কথা বলা হচ্ছে, তখন সেই সমতার প্রতিফলন আমাদের সম্প্রদায়েও ঘটানো প্রয়োজন। সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও পরিবর্তিত হতে হবে, তবেই টিকে থাকা সম্ভব।
খাসিয়া সেবা সংঘ নিজপাট-এর সহসভাপতি ফাইসাল খংলা বলেন - আগের যুগে আমাদের সমাজে পুরুষেরা ছিলেন সহজ-সরল। তারা সম্পত্তির প্রয়োজনীয়তা খুব একটা অনুভব করতেন না, কিংবা নিজেদের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। তবে সময় বদলেছে, বর্তমান প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন। তারা বুঝে নিয়েছে—নিজেদের ও আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য সম্পদের উপর ন্যায্য অধিকার থাকা কতটা জরুরি। আমিও মনে করি, যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাধারারও পরিবর্তন হওয়া উচিত। সমাজে সবাইকে সমান অধিকার দিতে হবে, তা না হলে আমাদের আগামী প্রজন্মও আমাদের মতোই বঞ্চনার শিকার হবে।
তবে এই দাবির বিপরীতে সম্প্রদায়ের প্রবীণ সদস্য ও নারীদের একাংশ বলছেন, খাসিয়া সমাজকে টিকিয়ে রাখতে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতে, নারীদের হাতে সম্পত্তির মালিকানা থাকায় তারা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পান, যা তাদের জন্য অপরিহার্য।
জৈন্তাপুরের খাসিয়া সেবা সংঘ নিজপাট এর নারী বিষয়ক সম্পাদক সুপ্রিতি ডিখার বলেন- জৈন্তাপুরের খাসিয়া সেবা সংঘ নিজপাটের নারী বিষয়ক সম্পাদক সুপ্রিতি ডিখা বলেন, আমাদের সমাজে নারীরা এখনও নানা ধরনের বৈষম্যের মুখোমুখি হন। কর্মসংস্থানে পুরুষদের সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি, অথচ নারীদের জন্য সে সুযোগ এখনো সীমিত। এই বাস্তবতায় নারীদের হাতে সম্পত্তির মালিকানা থাকা অত্যন্ত জরুরি, যাতে তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন। তবে আমি মনে করি, পুরুষদের একেবারে বঞ্চিত না করে ন্যায্যভাবে কিছুটা হলেও একটি অংশ দেওয়া উচিত—যাতে সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকে।
খাসিয়া সেবা সংঘ নিজপাট-এর সমাজ কল্যাণ সম্পাদক নীলা নাইয়াং বলেন, আমাদের সমাজে নারীদের সম্পত্তির মালিকানা দীর্ঘদিনের প্রথা, যা আমাদের ঐতিহ্য ও গর্বের অংশ। তবে সময় বদলেছে, সমাজেও কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। এখন অনেক নারী নিজ ইচ্ছায় ভাই বা ছেলেকে সম্পত্তির কিছু অংশ দিয়ে থাকেন। যদিও এটি কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, বা প্রতিষ্ঠিত নিয়ম নয়, তবু এর মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহাবস্থান ও সমঝোতার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই।
এ বিষয়ে আইনজীবীদের সাথে কথা বললে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ কাওছার আহমদ বলেন—বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইন ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সমান মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করবে। ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কারও প্রতি কোনোরূপ বৈষম্য করা যাবে না। এই সাংবিধানিক নির্দেশনার আলোকে যদি আমরা খাসিয়া সমাজের সম্পত্তি বণ্টনের প্রচলিত রীতিনীতির দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যে, ঐ সমাজে পিতার সম্পত্তিতে পুত্রদের কোনো অধিকার নেই; সম্পূর্ণভাবে কন্যাগণই উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তির মালিকানা পেয়ে থাকে।এমন ব্যবস্থায় সমাজের একটি অংশ, অর্থাৎ পুরুষগণ, উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে—যা রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সমতা ও বৈষম্যবিরোধী ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই এ ধরনের একতরফা উত্তরাধিকারনীতি শুধুমাত্র ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে টিকিয়ে রাখা যাবে না, যদি তা কোনো একটি গোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে।
আমরা মনে করি, খাসিয়া সমাজের এই সম্পত্তি বণ্টনের প্রথাগত পদ্ধতি একটি সুস্পষ্ট লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের উদাহরণ। এই বৈষম্য দূর করে সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হলে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার যথাযথ পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন অত্যন্ত জরুরি। সংবিধানের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই বিষয়টি রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের সক্রিয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
ব্লাস্ট এর সিলেট শাখার সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট সত্যজিৎ কুমার দাস বলেন - খাসিয়া সমাজে সম্পত্তি বণ্টনের প্রথা একটি মাতৃতান্ত্রিক রীতি, যেখানে নারীরাই মূলত সম্পত্তির মালিক এবং তা উত্তরাধিকারসূত্রে কন্যাদের মধ্যেই হস্তান্তরিত হয়। পুরুষরা সাধারণত শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করেন এবং সম্পত্তির ওপর তাদের কোনো অধিকার থাকে না। এই রীতিটি খাসিয়া সমাজের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য হলেও, আধুনিক সমাজে এটি লিঙ্গ-সমতার প্রশ্নে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারণ, সম্পত্তি বণ্টনে পুরুষদের বাদ দেওয়া অনেকের দৃষ্টিতে লিঙ্গবৈষম্যের শামিল হতে পারে।এদিকে সংবিধানের ২৭ ও ২৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের তাদের সমান অধিকার রয়েছে। অতএব, যদি কোনো প্রথা এই মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী হয়, তবে তা আইনগতভাবে পর্যালোচনা ও প্রতিকারের দাবি রাখে।
আমি মনে করি, প্রথা ও সংবিধানের মধ্যে একটি ভারসাম্য স্থাপন করে খাসিয়া সমাজের ঐতিহ্য রক্ষা এবং একইসঙ্গে বৈষম্য দূর—এই দুই লক্ষ্যই একসাথে অর্জন করা সম্ভব।
সমাজতাত্ত্বিকরা মনে করেন, খাসিয়া সমাজে সময়ের সঙ্গে কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে, তবে তা যেন তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সামাজিক কাঠামোকে সম্মান জানিয়ে হয়। সরকারের পক্ষ থেকেও এই বিষয়ে সচেতন দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন, যাতে আলোচনার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও ন্যায্য সমাধানে পৌঁছানো যায়।