সন্তান জন্ম নেওয়ার ঠিক ১২৩ দিন পর, কোলে দুধের গন্ধ আর শরীরে প্রসবের তাজা ব্যথা নিয়ে রমা সরেন ফিরে গেলেন বাগানে। কাঁধে ঝুড়ি, চোখে রোদ—আর মনজুড়ে অপরাধবোধ।
চা বাগানের শ্রমিক রমা সরেন যখন প্রথম সন্তান গর্ভে ধারণ করেন, তখন তাঁর সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল—সন্তান নয়, মাতৃত্বকালীন ছুটি। কারণ তিনি জানতেন, তাঁর হাতে সময় মাত্র চার মাস।
বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি খাতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের জন্য ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি বাধ্যতামূলক। অথচ সিলেট বিভাগের চা-বাগানগুলোতে কর্মরত হাজার হাজার নারী শ্রমিক এখনো পান মাত্র চার মাসের ছুটি। সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো শারীরিক ও মানসিকভাবে সংবেদনশীল সময়ের মাঝেই কোলের শিশুকে রেখে তাঁদের ফিরতে হয় পাতা তোলার কাজে— এই বৈষম্য শুধুই অমানবিক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নীতিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি এক প্রকার অবজ্ঞার প্রতিচ্ছবি। সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানগুলোতে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাদের অর্ধেকেরও বেশি নারী। তাদের অনেকে প্রজন্ম ধরে এই মাটিতে কাজ করলেও পান না ভূমির মালিকানা, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা কিংবা নিরাপদ মাতৃত্বকাল।
এ ব্যাপারে চা শ্রমিকদের সাথে কথা বললে ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা চা-শ্রমিক আকলিমা বেগমের চোখে যেন এক অদৃশ্য উদ্বেগ ভেসে ওঠে তিনি বলেন -আমি এবার প্রথমবার মা হতে যাচ্ছি। মা হওয়ার আনন্দে মন ভরে থাকার কথা, কিন্তু তার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে একটা দুশ্চিন্তা—এই ছোট্ট শিশুকে রেখে তো আবার কাজে ফিরতে হবে! মাত্র চার মাস সময় পাবো, চার মাসে কি কোনো সন্তান বড় হয়? ওর তখন সবচেয়ে বেশি দরকার থাকবে আমার কোলে মাথা রাখার, আমার কাছে জড়িয়ে থাকার। কিন্তু আমি তখন থাকবো বাগানের মাঠে। এই ভেবেই মনটা খারাপ লাগে।
চা-শ্রমিক শিল্পী গোয়ালা বলেন -আমার বাচ্চার বয়স ৬ মাস সন্তান জন্মের চার মাস পরেই আমাকে কাজে ফিরতে হয়েছে, কারণ আরও ছুটি চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বাচ্চা তখন ঠিকমতো দুধ খেতেও পারে না, তাও কাজে ফিরি। না ফিরলে ম্যানেজার বলে, ছুটি তো শেষ, না এলে চাকরি থাকবে না
আরেক চা শ্রমিক নিপা নায়েক বলেন - আমার বাচ্চা বয়স ৩ মাস, আমার হাতে এর এক মাস সময় আছে আমি কি ভাবে যে এই দুধের বাচ্চা রেখে কাজ করবো বুঝতে পারছি না কারণ আমার মন তো কাজে থাকবে না, মন থাকবে আমার সন্তানের কাছে।
এ ব্যাপারে চা শ্রমিক নেত্রী গুনতা বাড়াইক বলেন- আমরা চা বাগানের মায়েরা এখনো মাত্র চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাই। অথচ দেশের আইন অনুযায়ী ছয় মাস ছুটি পাওয়ার কথা। এটা আমাদের প্রতি এক ধরনের বৈষম্য।
আমরা গরিব মানুষ। মা হওয়ার আগে ঠিকমতো পুষ্টিকর খাবার খেতে পারি না। সন্তান জন্মের পর শরীর দুর্বল থাকে। এমন অবস্থায় মাত্র চার মাসেই কাজে ফিরতে হয়—এটা মা ও শিশুর জন্য খুব কষ্টকর।
ছয় মাস ছুটি পেলে মায়েরা একটু বিশ্রাম পেত, বাচ্চাটাও মায়ের যত্ন পেত। আমরা চাই, এই বৈষম্যের অবসান হোক।চা শ্রমিক মায়েদেরও ছয় মাস ছুটি দরকার—এটাই আমাদের ন্যায্য অধিকার।
চা বাগানের যুব নেতা সাইদুল ইসলাম সোহেল বলেন-দীর্ঘদিন ধরেই আমরা চা বাগানের নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি সংক্রান্ত বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে কথা বলে আসছি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বলতে হয়, এখনো পর্যন্ত এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। যেন নারী শ্রমিকদের কষ্টের প্রতি কারো কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।চা শিল্পের অগ্রগতিতে নারী শ্রমিকদের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের পরিশ্রমেই এই শিল্প বেঁচে আছে। অথচ যখন একজন মা হিসেবে তাদের একটু অধিক সময়ের ছুটি দরকার হয়, তখন সেই ন্যায্য দাবিটুকুও তারা পান না।আমরা জোর দাবি জানাই—চা শ্রমিক নারী মায়েদের জন্য চার মাসের পরিবর্তে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দ্রুত কার্যকর করা হোক। এটা কোনো অনুকম্পা নয়, এটা তাদের অধিকার।"
এ ব্যাপারে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলাম বলেন, ২০০৬ সালের শ্রম আইন চা শ্রমিকদের সামাজিক -অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা বিবেচনায় নিয়ে সংশোধন করা জরুরি। অগ্রাধিকার প্রদান করে নারী শ্রমিকদের জন্য আইনগত বিশেষ বিধান যুক্ত করা সময়ের দাবি। অন্যথায়, চা বাগানে কর্মরত বিরাট সংখ্যক নারী শ্রমিকরা মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে যেসব বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তা চলতেই থাকবে।আমি বিশ্বাস করি, এই বৈষম্য দূর করার জন্য দ্রুত আইন সংস্কারের মাধ্যমে চা শ্রমিক নারীদেরও অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে নারীদের মতো সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কর্মরত বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)-এর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেছেন, আমরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন সংগঠিত করছি, কিন্তু দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দিকে কেউ যথাযথ নজর দিচ্ছে না। এতে করে বৈষম্যের সমস্যা থেকে যায় অক্ষতই।তিনি আরও বলেন, দেশে যেখানে সকল নারী শ্রমিকরা পাচ্ছেন ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি, সেখানে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ চা শ্রমিক নারীদের জন্য মাত্র চার মাসই অনুমোদিত। এই মাতৃত্বকালীন ছুটির বৈষম্য চা-শ্রমিক নারীদের জন্য এক ধরনের নীরব অবমাননা, যা রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যেই অসাম্যের প্রকাশ। বিশেষ করে চা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য একটি গভীর সমস্যা।লক্ষ্মীকান্ত সিংহ জোর দিয়ে বলেন, “আমরা এই বৈষম্য দূর করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি এবং চা শ্রমিক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যেন তারা এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন যথাযথ নীতিমালা গ্রহণ ও কার্যকর বাস্তবায়ন, যা চা শ্রমিক নারীদের অধিকার সুরক্ষিত করবে এবং তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করবে।
এ বিষয়ে কথা হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মর্জিনা খাতুন জানান, সন্তান জন্মের পর একজন মা স্বাভাবিকভাবেই শারীরিকভাবে দুর্বল থাকেন। তার ওপর যদি মাত্র চার মাস বয়সী শিশুকে ঘরে রেখে কাজে যেতে হয়, তাহলে সেটি ‘মরার ওপর খাড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে, শিশুর পরিচর্যার কারণে মায়েরা রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না, যার প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। ফলে তারা আরও দুর্বল হয়ে পড়েন।
তিনি আরও বলেন, চা-বাগানের অনেক মা শ্রমিকই ঠিকমতো পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেন না। ফলে তারা অপুষ্টিতে ভুগে থাকেন, যা তাদের স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটায়।