আপনাকে কীভাবে আসল চা খাওয়াই দিদি? আসল চা তো আমরাই পাই না, আর তার স্বাদ কেমন তাও জানি না...
আবেগভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন চা-শ্রমিক কমিউনিটির সদস্য সুমি নায়েক।
বাংলাদেশে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ কাপ চা পান করেন মানুষ। শহরের অভিজাত রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ চায়ের দোকান পর্যন্ত—সবখানে চা একটি প্রিয় পানীয়। কিন্তু যাদের ঘামে ভেজে দেশের চা শিল্প, সেই চা-শ্রমিকরাই জানেন না আসল চায়ের স্বাদ কেমন।
চায়ের দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১০ কোটি কেজি চা উৎপাদিত হয়। অথচ এই বিশাল শিল্পের মূল কারিগর—চা-শ্রমিকদের কাছে উন্নতমানের চা রয়ে গেছে অধরাই।
বাগানে ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ শ্রমিক দৈনিক ১৭০ থেকে ২০০ টাকা আয় করেন। মাস শেষে তাদের গড় আয় দাঁড়ায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। এই সামান্য আয় দিয়ে পরিবারের খরচ চালানো যেখানে কষ্টসাধ্য, সেখানে উন্নত চায়ের স্বাদ তো কল্পনারও বাইরে।
সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগানের শ্রমিক মনোরমা টপ্পো বলেন, “ছোটবেলা থেকেই চা-গাছে কাজ করছি। কিন্তু সেই চা যে মানুষ খায়, তার স্বাদ কেমন—জানার সুযোগ আমাদের হয়নি। আমরা তো নিজেরাই কুড়িয়ে আনা পাতা শুকিয়ে চা বানাই।”
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশের উৎপাদিত চায়ের বড় একটি অংশ রপ্তানি হয় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। আর অভ্যন্তরীণ বাজারে ব্যবহৃত চায়ের বড় অংশ চলে যায় শহরের উচ্চবিত্ত শ্রেণির ভোগে। অথচ চা-শ্রমিকরা নিজেদের উৎপাদিত সেই চায়ের স্বাদ কখনও অনুভব করতে পারেন না।
সিলেট অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)-এর নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ বলেন, “চা-শ্রমিকরা সাধারণত নিজেরা তোলা পাতা দিয়েই চা তৈরি করেন। তারা মেশিনে প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেটজাত চায়ের স্বাদ জানেন না। আমার মতে, তাদের নিয়মিত রেশনের সঙ্গে যদি অন্তত একটি প্যাকেট চা যুক্ত করা হতো, তাহলে এই এক জায়গায় হলেও তারা বৈষম্যের শিকার হতো না। আর সেটি না পারলেও, বছরে অন্তত একবার হলেও প্যাকেট চা দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত।”
চা শ্রমিকদের প্রতি এই অবহেলা এবং বৈষম্য কেবল আর্থিক বা সামাজিক নয়, এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক বঞ্চনাও—যেখানে শ্রমিকেরা নিজেদেরই উৎপাদিত পণ্যের গুণগত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হন।