হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলায় ‘গোল্ড ব্রিকস’ ও একই এলাকার মাস্টার ব্রিক্স নামে দুটি ইটভাটা পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকায় অবৈধ হিসেবে লিপিবদ্ধ। উক্ত দুটি ইট ভাটা গুলোতে পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান করলেও এখনও চলমান রয়েছে আর ৮টি ইট ভাটা। এভাবে অবৈধ ১০টি ইট ভাটা নবীগঞ্জে চলছে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে উল্লেখ আছে- অন্য যেকোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে কৃষি জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না পাশ্ববর্তী ২ কিলোমিটারের মধ্যে কোন স্কুল মাদ্রাসা থাকতে পারবে না। কিন্তু নবীগঞ্জে ১০টি ইট ভাটা ফসলি জমি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে অবস্থিত। এসব ইট ভাটা গুলো কোন আইনে চলছে এটাই সাধারণ জনমনে প্রশ্ন বিরাজ করছে। এছাড়া নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়ন আওয়াামীলীগের সভাপতি আব্দুল মুহিত চৌধুরীর বিজনা ব্রীক ফিল্ড, আউশকান্দি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি ও চেয়ারম্যানের দিলাওয়ার হোসেন ব্রীক ফিল্ড সহ ১০টি ইট ভাটা ফসলি জমি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। আইন অমান্য করে হবিগঞ্জ জেলা যুবলীগ সভাপতি, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলার পলাতক আসামি আবুল কাশেম চৌধুরীর ইটভাটা ‘আবিদ-আতিয়া ব্রিকস’ চলছে বিস্তীর্ণ ফসলি জমির কেন্দ্রবিন্দুতে। ভাটার চারদিকে বোরো ধানের জমি, কয়েকশ ফুট দূরেই বানিয়াচং উপজেলার বলাকিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রতœা বাজার। এসব স্থানে প্রতিনিয়ত ধুলোবালি উড়ে পড়ছে।
এগুলোর ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ চারটি ইটভাটা বন্ধের জন্য ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসনে চিঠি পাঠানো হয়েছে; কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এজন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র হালনাগাদ না থাকা সত্ত্বেও ইটভাটাগুলো
চালানো হচ্ছে।
এদিকে, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হবিগঞ্জ জেলার গ্রাম ও শহরে মোট ১১৯টি ইটভাটার মধ্যে ৩০টির পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই এবং ৫০টির লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে আরও আগেই।
এ ব্যাপাওে হবিগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের মোঃ ইউসুফ আলীর ভাষ্য- পরিবেশগত ছাড়পত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া ২৬টি ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। অবৈধ ৪টি ইটভাটা এখনও চলমান। কিন্তু এগুলো বন্ধে জেলা প্রশাসনে চিঠি পাঠানো হলেও কাজ হয়নি।
তবে স্থানীয় সূত্র জানায়, পরিবেশ অধিদপ্তর যে ২৬টি ইটভাটা বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছে তার অধিকাংশই এখন পুরোদমে চলমান আছে। নিয়মিত ইট উৎপাদন করে বিক্রয় করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন থেকে দেওয়া লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া ৩০টি ইটভাটার মধ্যে রয়েছে নবীগঞ্জে ১০টি ইট ভাটা। এগুলো বন্ধের জন্য কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
সরেজমিনে দেখা যায়, নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি থেকে মাধবপুর উপজেলার আন্দিউড়া পর্যন্ত এলাকায় ইটভাটার অধিকাংশ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে ফসলি জমি ও বনাঞ্চলের আশপাশে গড়ে উঠেছে। হবিগঞ্জ- নবীগঞ্জ সড়কের পাশে রয়েছে ইটভাটা। এসবের আশপাশেই রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক। যা ইট প্রস্তুত আইন পরিপন্থি।
বাহুবল উপজেলার হাসপাতাল এলাকায় ‘নাসিম ব্রিকস’ নামে একটি ইটভাটা রয়েছে। অথচ পরিবেশ আইন অনুযায়ী হাসপাতালের এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো ভাটা স্থাপন করা যাবে না। আশ্চর্যজনকভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকায় ওই ইটভাটার ঠিকানাও উল্লেখ রয়েছে ‘হাসপাতাল এলাকা’।
অন্যদিকে ইটভাটার মালিকেরা প্রভাবশালী ও নানা রাজনৈতিক পদে থাকায় লোকালয়ের ভেতর দিয়েই ট্রাক্টরে করে মাটি আনা নেওয়া করা হচ্ছে। কেউ বাধা দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। মাটি আনা নেওয়ার ফলে ধুলোবালি উড়ে চলাচলকারী লোকজনের চোখেমুখে পড়ছে। লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভাটার কালো ধোঁয়া। এতে নিয়মিত বায়ুদূষণ ও পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।
সম্প্রতি হবিগঞ্জে এসে ইটভাটার পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেছেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে। তাই, লাইসেন্স এবং ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ইটভাটা পরিচালনা করা যাবে না। ’ তারপরও হবিগঞ্জে বেআইনি ইটভাটাগুলো কীভাবে চলছে? প্রশ্নের জবাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মোবাইল ফোনে বলেন,
‘পরিবেশের সুরক্ষা বিবেচনা করলে হবিগঞ্জ জেলায় একটি ইটভাটাকেও চলতে দেওয়া যাবে না। তারা ইউনিয়ন পরিষদসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরকে ম্যানেজ করে কাগজপত্র তৈরি করে পরিবেশের ছাড়পত্র নিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব ইটভাটার বেশিরভাগই কৃষিজমি, পাহাড় ও বনাঞ্চলের আশপাশে। অনেক ইটভাটার এক কিলোমিটারের ভেতরেই অবস্থিত স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানসহ জনবসতি। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন স্বোচ্চার না হলে
অবৈধ ইটভাটাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।’
ইটভাটার লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন সংক্রান্ত দায়িত্বে নিয়োজিত জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার সন্ধসঢ়;দ্বীপ তালুকদার বলেন, অনেক ইটভাটার মালিক লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছেন। সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।এরপর প্রয়োজনীয়ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হবিগঞ্জের কৃষি কর্মকর্তা একেএম মাকসুদুল বলেন, জমির উপরিভাগের ৬ ইঞ্চিমাটি থেকে প্রধানত ধান ও শাকসব্জি জাতীয় ফসলগুলো পুষ্টি গ্রহণ করে। বোরোও আমনের জমি থেকে এসব মাটি কেটে নেওয়ায় জমি উর্বরতা হারাচ্ছে। জমির এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বহুবছর প্রয়োজন। টপসয়েল কাটা বন্ধ না হলে ধান
উৎপাদনে বিপর্যয় নামবে।