টয়োটার স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি) গাড়িটি ব্যবহার হতো সিলেট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের সিলেটের দপ্তরে। সাবেক মন্ত্রীর দপ্তরের দায়িত্ব পালন করা আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল আলম জুয়েল গাড়িটি ব্যবহার করতেন। জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর গাড়িটি কয়েকদফা বিক্রির চেষ্টা চলে। কয়েকটি হাতবদলের পর সর্বশেষ এক বিএনপি নেতা কয়েকদিন ব্যবহারের পর না কেনায় ‘গনিমতের মাল’ উল্লেখ করে ফেসবুকে একটি পোস্টের সূত্র ধরে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়েছে।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) ‘শাহ আলী আহমেদ’ নামের এক ব্যক্তি ফেসবুকে গাড়িটি ব্যবহারের একটি ছবিসহ একটি পোস্ট করেন। তাতে তিনি লিখেন, ‘গনিমতের মাল এই গাড়িটি সাবেক পররাষ্টমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের এপিএস শফিউল আলম ওরফে জুয়েলের নামে রয়েছে এখনো। প্রাক্তণ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সহধর্মিনী সেলিনা মোমেন, তার বান্ধবী সিলেটের রহস্যময়ী হেলেন আহমেদ এবং জুয়েল গাড়িটি ব্যবহার করতেন। এটি এখন ভাগে পেয়েছেন সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী। তিনি অবশ্য তার নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় ব্যবহারের জন্য উপহার পেয়েছেন বলে দাবি করেন।
মিস্টার চৌধুরীর ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে টয়োটা ল্যান্ড ক্রইজার গাড়িটি ব্যবহার করছেন তিনি। ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগানো এই জিপ গাড়িটি সিলেট জেলা প্রশাসনের কাছে বেশ পরিচিত। ফলে বিএনপি নেতার জিম্মায় যাওয়ার পর থেকে গাড়িটি নিয়ে জেলাজুড়ে ব্যাপক কানাঘুষা চলছে। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী সাম্প্রতিক সময়ে গাড়িটি নিয়ে আদালত পাড়ায় যাতায়াত করেন। তাছাড়া গাড়িটি নিয়ে তিনি তার নির্বাচনি এলাকা সিলেট-৬ আসনও চষে বেড়াচ্ছেন। এর আগে তিনি একটি টয়োটা করোলা প্রাইভেটকার ব্যবহার করতেন বলে নিশ্চিত করেছেন তার সহকর্মী ঘনিষ্ঠজনরা।
জানা গেছে, ফেসবুকে পোস্টদাতা সিলেটে যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। সিলেটে তার গাড়ির ব্যবসা রয়েছে। ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলেছেন, যেহেতু নির্বাচনি এলাকা ইন্ডিকেট করে গাড়িটি ব্যবহার চলছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেহেতু ভোটের রাজনীতির দ্বন্দ্ব থেকে এ বিষয়টি কেবল প্রকাশ নয়, ফাঁস করা হয়েছে। সোমবার (১৪ এপ্রিল) রাতে ও মঙ্গলবার বিকেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ওই পোস্টের সূত্র ধরে বিভিন্ন নামে একাধিক পোস্টে একই তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের নামে ফটোকার্ডও ব্যবহার করা হয়। একটি টেলিভিশনের লোগো ব্যবহার করে ‘মুনতাহা জান্নাত’ নামের একজন, ‘সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমিনের কোটি টাকার গাড়ি দখল করে নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী’ এ কথা লিখে শাহ আলী আহমেদের ফেসবুক পোস্টটিই রিপোর্ট আকারে প্রকাশ করেছেন।
ফেসবুকে এই পোস্ট দেওয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর দেখা গেছে, এতে ‘লাইক-শেয়ার-কমেন্ট’ কম দেখাচ্ছে। তবে বিষয়টি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনও সরগরম। বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মুখরোচক নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের ম্যাসেঞ্জারে পোস্টটি বিভিন্নজন পাঠিয়ে সত্যতা জানতে চেয়েছেন।
গাড়িটির মালিক কে? এ ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিএআরটি) পরিবহন ও মালিকানার তথ্যভাণ্ডারে জিপটির (গাড়ি নম্বর: ঢাকা-মেট্রো-ঘ-১১-৬৯-৩৪) মালিক শফিউল আলম (পিতা বশির আহমেদ, ঠিকানা: ব্লক এ, রোড নম্বর ৪, হাউস নম্বর ১২, উপশহর, সিলেট)। তিনি একই ঠিকানার মাহবুবুল আলম নামের কাছ থেকে কিনেছিলেন। তার আগে মালিক ছিলেন একেএম শফিকুল ইসলাম (স্টান্ডার্ড অ্যান্ড চ্যাটার্ড ব্যাংক, দিলকুশা, ঢাকা)।
বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট শাখার নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে, প্রায় ১০ লাখ টাকা দামের হার্ড জিপ গাড়ির (টয়েটা-২০০২) রেজিস্ট্রেশন করা ১৬ নভেম্বর ২০০৫ সালে। ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন মেয়াদোত্তীর্ণ। ফিটনেসের মেয়াদ পেরিয়েছে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি। আর ট্যাক্স টোকেনের মেয়াদ ছিল গত বছরের ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সিলেটে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সিলেটে একটি দপ্তর খুলেছিলেন। নগরীর ব্যস্ততম এলাকা জিন্দাবাজারের একটি বহুতল মার্কেটের কক্ষে কেবিনেট আদলে দপ্তরটি সাজিয়ে ঘটা করে উদ্বোধনও করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর মোমেন আর পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব না পাওয়ায় সেটি পরিণত হয়েছিল তদবিরালয়ে। নিয়ন্ত্রক ছিলেন দপ্তরির দায়িত্বে থাকা শফিউল আলম জুয়েল। তবে তিনি নিজেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস পরিচয় দিতেন।
দপ্তরসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এটি সিলেটে ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তর’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। সেখানে দুজন সাংবাদিকও কাজ করতেন। তাদের একজন খবরের কাগজকে জানান, শফিউল ট্রাভেলস ব্যবসায়ী ছিলেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রীর মাধ্যমে ওই দায়িত্বে বসানো ছিল। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সিলেটে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার স্ত্রীসহ ২১৩ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা বিস্ফোরক মামলার আসামি হন দপ্তরি শফিউল। মামলার পর দপ্তর গুটিয়ে তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন। এ সময় তার ব্যবহৃত গাড়িটির ব্যবহার নিয়ে গোল বাঁধে।
পুরোনো গাড়ি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জানা গেছে, জিপ গাড়িটি রেন্ট-এ কারে মালিকবিহীন অবস্থায় পড়েছিল। বিয়ে-শাদিতে কমিউনিটি সেন্টারের মাধ্যমে ভাড়া যেত। এরমধ্যে বিক্রি হবে বলে জানানো হলে বিভিন্নজন গাড়িটি ব্যবহারও করেন। সর্বশেষ সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমেদ চৌধুরী গাড়িটি ‘গনিমতের মাল’ হিসেবে ব্যবহার করছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে ফেসবুক পোস্টে গাড়িটি ব্যবহারের যে ছবিটি প্রকাশ হয়েছে, তাতে দেখা গেছে সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমরান আহমেদ চৌধুরী গাড়িটিতে উঠছেন অথবা দেখছেন। এ ব্যাপারে এমরান আহমেদ চৌধুরী সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তার জবাব দেননি।
জেলা বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, এমরান আহমেদ চৌধুরী ছাত্রদল থেকে বিএনপির নেতৃত্বে আসা রাজনীতিবিদ। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আসীন হন। এরপর কাউন্সিলরদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত। সম্প্রতি সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটি প্রথম সদস্য মনোনীত হয়েছেন। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এমরান তার নিজ এলাকা সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার) আসনে বিএনপিদলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। ওই আসনটিতে তখন ছাত্রদল থেকে বিএনপি রাজনীতিতে সক্রিয় ফয়সল আহমদ চৌধুরী মনোনয়ন পাওয়ায় এমরান মনোনয়ন বঞ্চিত হন। এরপর থেকে এমরান মনোনয়ন প্রত্যাশায় নিজ এলাকায় গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।