রাত তিনটায় হাউমাউ করে কাঁন্নার শব্দ। গভীর রাতে ইনারুন বেগমের এমন কাঁন্নার শব্দে মেয়ে তান্নির ঘুম ভেঙ্গে যায়। মাঝরাতে মায়ের কাঁন্না দেখে মেয়ে তান্নির বুঝতে বাকি রইলো না, বুকের মানিক তারেকের কথা হয়তো মনে পড়ে গেছে।
২০২৪ সালের রমজান মাসে সন্তান তারেক সেহরির সময় মায়ের ঘুম ভাঁঙ্গাতো। মা-ছেলে মিলে একসাথে সেহরি খেয়ে রোজা রাখতেন এবং ইফতার করতেন। ছেলের সাথে মাহে রমজানে কাটানো স্মৃতি যেন কিছুতেই ভুলতে পারছেন না ইনারুন বেগম। সেহরির সময় হলেই কানে ভেসে ওঠে ছেলে তারেকের গলার সুর। ছেলেকে হারিয়ে রমজানের আনন্দ যেন বিষাদে পরিণতে হয়েছে তাঁর।
শুধু ইনারুন বেগম নয়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থাণে নিহত শহীদ পরিবারের সদস্যদের মাঝেও যেন একই দৃশ্য বিরাজ করছে এই রমজানে। প্রিয়জনকে হারিয়ে ভালো কাটেনি শহীদ পরিবারের সদস্যদের রমজান মাস। তাই কষ্ট, আর্তনাদ বিরাজ করছে শহীদ পরিবারে।
ইফতার ও সেহরীতে গত রমজানে যারা ছিলেন পরিবারের মধ্য মণি, এই রমজানে তারা সবাই পরকালের বাসিন্দা, কেবলই স্মৃতি। প্রিয়জনকে ছাড়াই রমজান মাস কাটাতে হয়েছে শহীদ পরিবার গুলোর।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রাণহারানো বিয়ানীবাজারের সন্তান সাংবাদিক এটিএম তুরাব, দোকান কর্মচারী তারেক,ফল ব্যবসায়ী ময়নুল, ও কলেজ ছাত্র রায়হান।
এছাড়াও গোলাপগঞ্জ উপজেলার মাদ্রাসা ছাত্র পাবেল,ব্যবসায়ী তাজ ও নাজমুল, রাজমিস্ত্রি সানি, টেইলার্স কর্মী জয়, মেকানিক্যাল মিস্ত্রি মিনহাজ ও সিএনজি অটোরিকশা চালক গৌছ।
এছাড়াও আন্দোলনের সময় সিলেটের বাইরে প্রাণ হারাণ আরো কয়েকজন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাড্ডায় মোরগের দোকানে চাকুরী করা সদর উপজেলার ওয়াসিম এবং হবিগঞ্জে পল্লি বিদ্যুতের লাইনম্যান মোস্তাক ও নারায়নগঞ্জে টাইলস মিস্ত্রির কাজে থাকা বিয়ানীবাজারের সোহেল।
এবারের রমজান মাসে সবাই যখন প্রিয়জনকে নিয়ে ইফতার ও সেহরী উপভোগ করছেন। পক্ষান্তরে প্রিয়জনদের বিয়োগ ব্যথা কাঁদিয়েছে এসব পরিবারের সদস্যদের।
প্রিয়জনদের ছাড়া কেমন কাটছে শহীদ পরিবারের রমজান মাস শ্যামল সিলেটের সঙ্গে আলাপচারিতায় তারা শূন্যতার ব্যকুলতা তুলে ধরেন। ভাই হারিয়ে বোনের কান্না, পিতাকে হারিয়ে অবুঝ শিশুর কান্না, সন্তান হারিয়ে মা-বাবার কান্না, কে দেবে কাকে সান্তনা। তাদের কান্না এখন নিত্যদিনের।
শহীদ এটিএম তুরাবের বড় ভাই আবুল আহছান মো. আজরফ জাবুর বলেন, মায়ের সাথে ইফতার করাটা তার সবচেয়ে পছন্দের ছিল। কাজের ফাঁকে বেশির ভাগ সময়ই বাসায় ইফতার করতো। বিরিয়ানী এবং দুধ ছিল তার প্রিয় খাবার। ইফতারে সে সব সময় বিরিয়ানী খেতে পছন্দ করতো। কিন্তু এবার তুরাব ছাড়া একবারে বিবর্ণ তার পরিবার। কিছুতেই তার স্মৃতি ভুলতে পারছেন না।
শহীদ জয় আহমেদের বড় ভাই মনোয়ার বলেন, সেহরীর সময় সে মায়ের জন্য দুধ ও কলা নিয়ে বাসায় ফিরতো। এখন আর সে কলা ও দুধ নিয়ে আসেনা, তা মনে করে মা শুধু কাঁদেন। পরিবারের সাথে একসাথে ইফতার করতাম আমরা। এখন জয় কে ছাড়া ইপতার করতে হয়।
নিহত মিনহাজের বড় ভাই সাঈদ আলম বলেন, পরিবারের সাথেই মিনহাজ ইফতার করতো। ইফতার শেষে আমরা আবার দোকানে চলে আসতাম। গত রমাদ্বানে সে আমাকে দোকানের কাজে সাহায্য করেছিল । দোকানে গেলেই তার কাজের স্মৃতি ভেসে ওঠে।।
শহীদ তাজ উদ্দিনের স্ত্রী রুলী বেগম বলেন, স্বামী তাজ উদ্দিনের খিচড়ি খুব পছন্দ ছিল। প্রতিদিন বাসায় ফেরার পথে সবার জন্য ফল মূল ও বিভিন্ন রকমের খাবার নিয়ে আসতেন। বড় মেয়ে তানহা এখনো ভুলতে পারছে না বাবার সাথে ইফতার করার সেইস্মৃতি। বাবার কাছে বিভিন্ন বায়না থাকতো তার। গত রমাদ্বানে যেখানে বাবার কোলে বসে ইফতার করেছিল এবার বাবাকে ছাড়াই তাদের ইফতার করতে হচ্ছে।
শহীদ নাজমুলের ভাই সাইফুল বলেন, গত রমজানে প্রথম দুই-তিন দিন নাজমুল ভাইসহ আমরা বাসায় ইফতার করেছিলাম। তারপর থেকে দোকানে ইফতার করতাম। নাজমুল সব সময় নিজ হাতে মুড়ি চাটনি তৈরি করতো। যা ছিল তার সবচেয়ে পছন্দ। মুড়ি চাটনি ছাড়া তার ইফতার চলতো না। এবার তাকে ছাড়া ইফতার করা টা খুব কষ্টের লাগছে। কারন এবার রমজনে নাজমুলও নেই এবং আমাদের সেই দোকানও নেই। কেননা নাজমুলের মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্টান তানজিনা সু-ষ্টোর পরিচালনার কেউ না থাকায় আমরা তা বিক্রি করে দেই।
শহীদ ওয়াসিমের বোন শীপা আক্তার বলেন, তাদের মা মারা যাওয়ার পর থেকেই ছোট ওয়াসিমকে তিনি লালন-পালন করেছেন। একসাথেই কেটেছে ভাই বোনের প্রতিটি রমজান। ইফতারের আগমূহুর্ত বোনের জন্য নিজের হাতে জুস তৈরি করতো সে। ইফতারে বেশি পরিমান জুস খেতেই পছন্দ করতো ওয়াসিম। ভাই-বোন মিলে গত রমজানের স্মৃতিটা যেন কিছুতেই ভুলতে পারছেন না বোন শীপা। তাইতো প্রতিদিন ওয়াসিমের প্রিয় খাবার জুস হাতে নিয়ে কাঁদতে থাকেন তিনি।
শহীদ মোস্তাক এর বড় ভাই দুলাল বলেন, মোস্তাক তার চাকুরীর সুবাধে বেশির ভাগ সময় সিলেটের বাহিরে ইফতার করতো। তারপরও ছুটি নিয়ে এসে আমাদের সাথে ইফতার করতো। গত রমজানে কয়েকদিন আমাদের সাথে কাটিয়েছে। তার আলাদা কোন চাহিদা ছিলনা। যখন যে খাবার সামনে পেত, তা নিয়েই সে সন্তুষ্ট থাকতো। মায়ের সাথে গত ঈদের আগে ছিল তার সর্বশেষ ইফতার।এবার মোস্তাকের শূণ্যতা মাকে কাঁদাচ্ছে। তার কথা মনে করে বার বার ভেঙ্গে পড়ছেন তিনি।
শহীদ পাবেল আহমদ কামরুলের মা দিলারা বেগম বলেন, আমার ছেলে গত রমজান মাসে এক দিনের ছুটি নিয়ে এসে আমাদের সাথে ইফতার করতে। ওই একদিনই সে এসেছিল বাড়ীতে ইফতার করতে। অন্যান্য রমজান মাসে সে আমাদের সাথে ইফতার করতো। কিন্তু গত বছর থেকে সে শহরে চাকুরীতে যোগদান করে। এখন প্রতিটা মূহুর্ত আমার ছেলের কথা মনে হয়। বাসার কাজে সে আমায় অনেক সাহায্য করতো।
শহীদ সানি আহমেদের মা রুবিয়া বলেন, ছেলে আমার রাজমিস্ত্রির কাজ করায় শারিরিক পরিশ্রম একটু বেশিই হতো। তারপরও নিয়মিত রোজা রাখতো। কাজ শেষ করে প্রতিদিন বিকালের মধ্যেই সাধ্যমত যা পারতো তা নিয়ে বাসায় ফিরতো। এখনো তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না সানি হারিয়ে গেছে চিরদিনের মতো। সানি ফেরার আপেক্ষায় থাকেন মা।
শহীদ গৌছ উদ্দিনের বড় ভাই আবুল কালাম জানান, গত রমজান মাসে পরিবারের সবাই একসাথে ইফতার করেছিলেন। সে কাজ থেকে ইফতারের পূর্বেই বাসায় ফিরতো। আমার মা দুধ পছন্দ করেন। তাই আমিও গৌছের মধ্যে প্রতিযোগীতা হত, কে মায়ের জন্য দুধ আনবে। বাধ্য হয়ে ৫দিন গৌছ এবং ৫দিন আমি মায়ের জন্য দুধ নিয়ে আসতাম। এসব স্মৃতি মনে করে মা সব সময় কাঁদেন। ইফতারিতে গৌছের পছন্দের খাবার ছিল পোলাও যদিও আমরা সবাই নরম খিচুড়ী খেতে পছন্দ করতাম। আর পোলাও দেখলেই ভাই গৌছের কথা মনে পড়ে যায়।
শহীদ তারেকের বোন তান্নি জানান, গত রমজানে একসাথে ইফতার ও সেহরী খেয়েছি। এবার রমজানে সে নেই। সেহরীর সময় সে আমাদের সবার ঘুম ভাঙাতো। কোন এক মুরব্বীর ভাইরাল হওয়া সেই ডায়লগ ”ফতা খাওয়ার সময় ওই গেছে, খাইলে খাও না খাইলে না নাই” কানের কাছে বাজিয়ে আমাদের কে ঘুম থেকে ওঠাতো। তাই ইফতারী ও সেহরীর ওই সময় তারেক কে ভুলতে পারিনা।
শহীদ ময়নুলের মেয়ে ফাতিমা বলেন, আব্বু আমাদের জন্য কলা আম, ও জিলাপি নিয়ে আসতেন ইফতারির জন্য। শত ব্যস্ততার মাঝেও আব্বু আমাদের সাথে নিয়মিত ইফতার করতেন। কখনো ইফতার করা মিস করতেন না। কিন্তু এবারের রমজানে আব্বুকে ছাড়া ইফতার করাটা খুব কষ্ঠকর লাগছে।
শহীদ রায়হানের ছোট ভাই সিয়াম বলেন, গত রমজান মাসে আমরা দু’ভাই একসাথে দোকান খুলতাম। দোকানেই ইফতারকরতাম। রাত্র ১২ টার পর আমরা দোকান বন্ধ করে বাসায় ফিরতাম। এখন ছোট ভাই সোহরাব কে নিয়ে দোকান চালাই। রায়হান থাকতে আমার অনেক সাপোর্ট হত।
শহীদ সোহেলের ছোট ভাই রুহেল বলেন, বড় ভাই সোহেল কে নিয়ে বেশ আনন্দেই কেটেছিল তাদের পরিবারের দিনগুলো। একসাথে খাওয়া-দাওয়া সহ সময় গুলো ছিল উৎসব মূখর। ভাইবোন মিলেমিশেই যেন তাদের পরিবার কে গড়ে তুলেছিলেন একখন্ড শান্তির নীড়। তাই প্রিয় ভাইকে হারিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলা রুহেল আর কিছুই বলতে পারলেন না।